গাজায় আবারও ফিরতে শুরু করেছে প্রাণচাঞ্চল্য। গাজার বাসিন্দারা যুদ্ধ বন্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া এই যুদ্ধে ৬৭ হাজার ৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। পুরো গাজায় নেমে এসেছে মানবিক বিপর্যয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত গাজার ৯২ শতাংশ আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি এখন তাঁবু বা অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছে।
বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি নারী রিম জিদিয়াহ আল জাজিরাকে বলেন, গাজা শহরে ফিরে আসার পর তিনি কিছুই পাননি। শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। জিদিয়াহ বলেন, ফিরে আসা ব্যক্তিরা ‘এত হারিয়ে যাওয়া’ এবং অসহায় বোধ করছেন। মানুষ রাস্তায় হাঁটছে এবং নিজেদের জিজ্ঞাসা করছে, ‘আমাদের কী হয়েছে?’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমরা জানি না কী করব। আপনি এমন এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছেন, যিনি দুই বছর ধরে গণহত্যার মধ্যে বেঁচে ছিলেন। আমরা সবকিছু হারিয়েছি। আমাদের সবকিছু প্রয়োজন। আমরা সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের সবকিছু দরকার।’
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ গাজা শহরে ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছে সেখানকার সিভিল ডিফেন্স সংস্থা। সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসসাল বলেন, শুক্রবার ইসরায়েলের হামলা বন্ধ হওয়ার পরপরই বিপুলসংখ্যক মানুষ গাজা শহরের দিকে ফিরতে শুরু করে। তিনি এএফপিকে বলেন, গত শুক্রবার থেকে এখন পর্যন্ত ৫ লক্ষাধিক মানুষ গাজা শহরে ফিরে এসেছে। দুই বছরের দীর্ঘ সংঘাতের পর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতেই ধ্বংসস্তূপে ঢাকা গাজা শহর আবারও মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে উঠছে।এর আগে ইসরায়েলের টানা বিমান ও স্থল হামলায় গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। সংঘাত শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং গাজার অধিকাংশ অঞ্চল পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। যুদ্ধবিরতির আগে ইসরায়েলের তীব্র বোমাবর্ষণ ও অভিযানের কারণে প্রায় ৭ লাখ মানুষ গাজা শহর ও উত্তরাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।
গাজা উপত্যকায় নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়া ফিলিস্তিনিরা এ যাত্রায় মিশ্র অনুভূতির মধ্যে রয়েছে। ঘরে ফেরার আনন্দের পাশাপাশি দুই বছরের যুদ্ধে তৈরি গভীর বেদনার কথা জানিয়েছে তারা। ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপির বরাতে এ খবর দিয়েছে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা। গাজার দক্ষিণে খান ইউনিসে ৩২ বছর বয়সি আমির আবু ইয়াদে বলেন, ‘এই অবস্থার জন্য (ফিরতে পারা) আল্লাহর শোকর করি, যদিও আমরা ক্ষত আর বেদনায় পরিপূর্ণ মন নিয়ে আমাদের এলাকায় ফিরে যাচ্ছি।’
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, বিপুল সংখ্যায় ত্রাণবাহী লরি এখনো গাজায় প্রবেশ করেনি। সংস্থাটি বলছে, তাদের লক্ষ্য শহরজুড়ে ১৪৫টি জায়গায় নিয়মিত খাদ্য বিতরণ আবার শুরু করা। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, বৃহস্পতিবার ৫০০ ট্রাক ত্রাণ গাজায় প্রবেশ করেছে। জাতিসংঘের মতে, গাজার প্রায় ৫ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্যে আছে। তবে ইসরায়েল এসব প্রত্যাখ্যান করেছে। নেতানিয়াহু বলেছেন, কোথাও ক্ষুধা দেখা গেলে তার দায় সাহায্য সংস্থা ও হামাসের। গাজা উপত্যকায় প্রতি মাসে ৬২ হাজার মেট্রিক টন মানবিক সহায়তা পৌঁছানো প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রতিনিধি ও ফিলিস্তিনের কান্ট্রি ডিরেক্টর আন্তোইন রেনার্ড। শনিবার তিনি বলেছেন, গত দুই মাসে আমরা গাজায় আরও বেশি পরিমাণে সহায়তা পাঠাতে পেরেছি, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। গাজায় যে পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ করা হতো, তার মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই আমরা সরবরাহ করতে পেরেছি। এখন আমাদের প্রতি মাসে ৬২ হাজার মেট্রিক টন সহায়তা গাজা উপত্যকায় পৌঁছানো দরকার।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় ফিলিস্তিনিরা গাজার উত্তরে ফিরতে শুরু করেছে। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার এই চুক্তির ফলে দুই বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘাত অবসানের আশা দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, ইসরায়েলি সৈন্যরা যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপ বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত মোতায়েন লাইনগুলোতে প্রাথমিকভাবে প্রত্যাহার সম্পন্ন করেছে। গাজায় ত্রাণ প্রবেশেও সম্মতি দিয়েছে নেতানিয়াহু সরকার। যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি সমঝোতার আওতায় ৪৮ জিম্মিকে মুক্তি দিতে হামাসকে সোমবার স্থানীয় সময় ১২টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্যে ২০ জন জীবিত রয়েছেন। বাকিদের মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।
হামাসের শীর্ষ কর্মকর্তা ওসামা হামদান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সমঝোতা অনুযায়ী সোমবার সকালে বন্দিবিনিময় শুরু হবে। আভিভ হাভরনের পরিবারের সদস্যদের ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার সময় হত্যা করা হয়েছিল। তার পরিবারের সাতজনকে অপহরণ করা হয়েছিল। তেলআবিবে বিবিসিকে তিনি বলেন, এটা কমিউনিটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে তারা ফিরে আসছে। এটা ছাড়া আমরা আমাদের জীবন আবার শুরু করতে পারি না। আমার বোনেরা ও দুই ভগ্নীপতি খুন হয়েছে। পরিবারের সাতজনকে অপহরণ করা হয়েছে। আমার বড় বোন, তার মেয়ে এবং নাতিকে অপহরণ করা হয়েছে। কমিউনিটির চারজনের মৃতদেহ এখনো গাজায়। চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলের হাতে থাকা বাকি সব জিম্মি এবং প্রায় ১ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
হামাসকে সোমবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার মধ্যে জিম্মিদের মুক্তি দিতে হবে। তবে ঠিক কখন বা কোথায় এই মুক্তি ঘটবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। গাজায় হামাসের হাতে বন্দি থাকা ইসরায়েলি জিম্মিদের সম্ভাব্য মুক্তির আগে তেলআবিবে শনিবার এক সমাবেশে অংশ নিয়েছে লাখ লাখ ইসরায়েলি। ওই সমাবেশে অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেছেন, জিম্মিরা ঘরে ফিরে আসছে। তিনি গাজা যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের ফেরানোর বিষয়টিকে সম্ভব করে তোলায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশংসা করেছেন। এদিকে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরায়েলি সেনা সরে যাওয়ার পর গত দুই দিনে প্রায় ৫ লাখ মানুষ গাজার উত্তরাঞ্চলে ফিরে এসেছে। অন্যদিকে যুদ্ধ অবসানের সমঝোতা চূড়ান্ত করতে একটি শীর্ষ বৈঠক আয়োজনের বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে মিশর। ট্রাম্পসহ প্রায় ২০ জন নেতা শার্ম আল-শেখে সোমবার ওই বৈঠকে অংশ নেবেন বলে মিশরের প্রেসিডেন্টের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন।