ঢাকা সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫

লিবিয়ার উপকূলে ৬১ অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃতদেহ উদ্ধার

ভিনদেশ ডেস্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৫, ০১:০২ এএম

ভূমধ্যসাগর আবারও সাক্ষী হলো এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের। ইউরোপে ভালো জীবনের আশায় মরিয়া হয়ে যাত্রা শুরু করা অসংখ্য অভিবাসনপ্রত্যাশীর জীবন শেষ হয়েছে লিবিয়ার উপকূলের নোনা জলে। গত দুই দিনে দেশটির পশ্চিম সাগরতীর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে অন্তত ৬১ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর নিথর দেহ।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানা যায়, লিবিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবা সংস্থা দ্য ইমার্জেন্সি মেডিসিন অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টার রোববার জানিয়েছে যে গত শুক্রবার ও শনিবার দেশটির পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে এসব মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয় স্থানীয় উদ্ধারকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা।

ঘটনার পেছনের কারণ অনুসন্ধানে ধারণা করা হচ্ছে, গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা হওয়া একটি ইঞ্জিনচালিত নৌযান দুর্ঘটনায় এই মৃত্যুগুলো ঘটে। সেই নৌকায় ছিলেন অন্তত ৭৫ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন সুদানের নাগরিক। সাগরে যাত্রার কিছু পরেই নৌযানটিতে আগুন ধরে যায়, এরপর থেকেই সেটির আর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। উদ্ধার হওয়া মৃতদেহগুলো সেই নৌযানের যাত্রী বলেই সন্দেহ করছে কর্তৃপক্ষ।

লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে মৃতদেহ উদ্ধারের অভিযান শুরু হয় শুক্রবার সকালে। ত্রিপোলি থেকে পশ্চিমে মেল্লিতাহ নামের এলাকায় প্রথমে তিনজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। একই দিনে জুওয়ারা উপকূলে উদ্ধার করা হয় আরও ১২ জনের দেহ। পরদিন শনিবার উদ্ধারকর্মীরা জুওয়ারা, আবু কাম্মাশ এবং মেল্লিতাহ এলাকার উপকূলে অভিযান চালিয়ে আরও ৪৬ জনের মৃতদেহ খুঁজে পান। দ্য ইমার্জেন্সি মেডিসিন অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টার জানায়, উদ্ধারকৃত মৃতদেহগুলোর মধ্যে কিছু স্থানীয়ভাবে দাফন করা হয়েছে, আর কিছু অটোপসির (ময়নাতদন্ত) জন্য মর্গে রাখা হয়েছে। সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানায়, ‘আমরা মৃতদের পরিচয় শনাক্ত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, তবে অনেক দেহের অবস্থা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত যে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে।’ এই দুর্ঘটনা নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে লিবিয়া থেকে ইউরোপগামী অভিবাসী নৌযান ডুবে যাওয়ার ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশন জানিয়েছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টায় প্রতি বছর হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। তাদের বেশির ভাগই আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত, দারিদ্র্যপীড়িত বা জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো থেকে আসে।

লিবিয়া, বিশেষ করে এর পশ্চিম উপকূল, ইউরোপগামী অভিবাসীদের জন্য বহু বছর ধরেই একটি  ‘গেটওয়ে’ বা প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত। মানব পাচারকারীরা এই অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, যারা দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে বিপুল অর্থ নিয়ে তাদের ভঙ্গুর নৌযানে তুলে দেয়। এসব নৌযানের বেশির ভাগই নিরাপত্তাহীন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে এবং মাঝ সাগরে দুর্ঘটনার শিকার হয়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিসহ শতাধিক শহরে প্রায় ৪৫টি দেশের নাগরিকসহ ৮ লাখ ৯৪ হাজার ৮৯০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী বসবাস করছেন। তাদের অধিকাংশই আফ্রিকার দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল থেকে এসেছেন, বিশেষ করে নাইজার, চাদ, মিশর, সুদান ও ইরিত্রিয়া থেকে। এসব মানুষের অনেকেই নিজেদের দেশে যুদ্ধ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, দারিদ্র্য বা জলবায়ুজনিত বিপর্যয় থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু লিবিয়ায় এসে তারা মানব পাচারকারী চক্রের ফাঁদে পড়ে যায়। অনেকে দাসত্ব, যৌন শোষন এবং জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য হয়।

তবু ইউরোপে পৌঁছানোর আশায় তারা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে আবারও সাগরে যাত্রা করে। রয়টার্স জানায়, সাম্প্রতিক এ ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো লিবিয়ায় মানব পাচার ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে আরও শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা বলেছে, ‘প্রতিটি এমন দুর্ঘটনা শুধু একটি নৌযানের ধ্বংস নয়, বরং মানবতার জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।’ তারা আরও যোগ করে, ভূমধ্যসাগরে উদ্ধার অভিযানের সক্ষমতা বাড়াতে এবং অভিবাসন রুটে নিরাপদ বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই এগিয়ে আসা জরুরি। এই দুর্ঘটনা যেমন একটি সংখ্যাগত ট্র্যাজেডি, তেমনি এর পেছনে আছে শত শত পরিবারের অন্ধকার ভবিষ্যৎ। সুদান থেকে পালিয়ে আসা মানুষের অনেকেই ইতিমধ্যে যুদ্ধ ও ক্ষুধার্ত বাস্তবতার শিকার। তাদের কাছে এই নৌযাত্রা ছিল শেষ আশার প্রতীক। কিন্তু সেই আশাই এখন পরিণত হয়েছে মৃত্যুর যাত্রায়। তথ্যসূত্র : রয়টার্স