বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের ইস্যু করা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বিদেশে সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। আগে একসময় সবচেয়ে বেশি খরচ হতো ভারতে, কিন্তু ভিসা জটিলতায় তা ৭ নম্বরে নেমে এসেছে। আর ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা ডেবিট কার্ড বিদেশে বেশি ব্যবহার হচ্ছে চীনে, প্রি-পেইড কার্ড বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে যুক্তরাজ্যে।
এই হিসাব গত এপ্রিল মাসের; এটি শুধু দেশের বাইরে খরচের হিসাব। ক্রেডিট কার্ডে দেশে-বিদেশে লেনদেনসংক্রান্ত চলতি বছরের মে মাসের হালনাগাদ প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫৬ ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড সেবা দিয়ে থাকে, যাদের তথ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ দেশের ক্রেডিট কার্ডের এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে দেশের অভ্যন্তর ও বিদেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের এবং দেশের ভেতরে বিদেশি নাগরিকদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশিরা বিদেশে ভ্রমণ ও কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার কিছুটা কমিয়ে দিয়েছেন। বিদেশে ভ্রমণ ও লেনদেনে বাংলাদেশি নাগরিকদের খরচের ধরন পরিবর্তন হচ্ছে। দেশ-বিদেশে বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার ধারাবাহিক কমছে। তবে তুলনামূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবে এই খাতে ব্যয় বাড়লেও ব্যাপক হারে কমেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। একসময় বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডে খরচের শীর্ষে ছিল ভারত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে বিদেশের মাটিতে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশিরা ৩৮৬ কোটি টাকা খরচ করেছেন। এই পরিমাণ আগের মাস এপ্রিলের তুলনায় ১৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। এপ্রিলে খরচ হয়েছে ৪৬৮ কোটি টাকা। বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমে আসার কারণ প্রসঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারে পরিবর্তন আসার পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। ফলে তাদের সব ধরনের কার্ড ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। দেখা গেছে, ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা থাকলেও বিদেশে সেই অর্থ তারা খরচ করতে পারছেন না। আবার ভারতের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বিদেশে কার্ডের লেনদেনে।
দেখা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে ভারতে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড লেনদেন নেমে এসেছে মাত্র ২১ কোটি টাকায়; আগের মাস এপ্রিলের তুলনায় যা ৩২ দশমিক ২৬ শতাংশ কম। মে মাসে ভারতে এই খাতে ব্যয় হয়েছিল ৩১ কোটি টাকা। ক্রেডিট কার্ডের মধ্যে মে মাসে বিদেশে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেÑ এই অঙ্ক প্রায় ৫৩ কোটি টাকা। এরপর চীনে ৪০ কোটি টাকা, থাইল্যান্ডে ৩৫ কোটি টাকা, যুক্তরাজ্যে ৩৪ কোটি টাকা, সিঙ্গাপুরে ৩২ কোটি টাকা, মালয়েশিয়ায় ২৪ কোটি, ভারতে ২১ কোটি টাকা, নেদারল্যান্ডসে ১৭ কোটি টাকা, সৌদি আরবে ১৭ কোটি টাকা, কানাডায় ১৬ কোটি টাকা, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৩ কোটি টাকা, অস্ট্রেলিয়ায় ১২ কোটি টাকা এবং আয়ারল্যান্ডে ১২ কোটি টাকা। ক্রেডিট কার্ডের মধ্যে মে মাসে বিদেশে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে ভিসা কার্ড ব্যবহার করে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৭৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে ভিসা কার্ড ব্যবহার করে, ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ মাস্টারকার্ড এবং ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ এমেক্স কার্ড ব্যবহার করা হয়েছে।
এদিকে ক্রেডিট কার্ডে গত মে মাসে বিদেশে বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেছেন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১০৭ কোটি টাকা। এরপর ক্রেডিট কার্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৬২ কোটি টাকা। এরপর ক্রেডিট কার্ডের তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে নগদ অর্থ উত্তোলনে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৪২ কোটি টাকা।
এদিকে ডেবিট কার্ড দিয়ে গত মে মাসে দেশের বাইরে খরচ হয়েছে ২৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়ারল্যান্ডে খরচ হয়েছে ২৯ কোটি টাকা, যুক্তরাজ্যে ২৮ কোটি টাকা, যুক্তরাষ্ট্রে ২৬ কোটি টাকা, চীনে ২৫ কোটি টাকা, ভারতে ২০ কোটি টাকা। প্রিপেইড কার্ড দিয়ে দেশের বাইরে খরচ হয়েছে ৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে সৌদি আরবে খরচ হয়েছে ৭ কোটি টাকা, যুক্তরাষ্ট্রে ৫ কোটি টাকা, ভারতে ৪ কোটি টাকা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যে ৩ কোটি টাকা করে।
বিদেশে কমলেও দেশে ক্রেডিট কার্ডে খরচ কমেছে
বিদেশে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার কমলেও দেশের মধ্যে ব্যবহার বেড়েছে। এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বেড়েছে ৭ শতাংশ। এপ্রিলে যেখানে লেনদেন ছিল ৩ হাজার ১৬ কোটি টাকা, মে মাসে তা কমে ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ভেতরে ১১টি খাতে সবচেয়ে বেশি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, পরিষেবার বিল পরিশোধ, খুচরা কেনাকাটা, নগদ উত্তোলন, পোশাক কেনাকাটা, ওষুধ ও ফার্মেসি, অর্থ স্থানান্তর, পরিবহন খাতে ব্যয়, ব্যাবসায়িক ও পেশাদারি সেবা এবং সরকারি সেবার বিল প্রদান। এসব খাতের মধ্যে নগদ উত্তোলন ছাড়া অন্য সব খাতে মে মাসে কম খরচ হয়েছে। এ ছাড়া ৭৩ দশমিক ২১ শতাংশ লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে ভিসা কার্ড ব্যবহার করে, ১৮ দশমিক ১৪ শতাংশ মাস্টারকার্ড এবং ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ এমেক্স কার্ড ব্যবহার করা হয়েছে।