চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারের মুদ্রানীতিতেও গুরুত্ব পাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এ জন্য নীতি সুদহারে কোনো পরিবর্তন থাকছে না। ফলে আগামী ছয় মাস ব্যাংক ঋণের সুদহার কমার আশা নেই।
তাই এবারও উপেক্ষিত থাকছে বেসরকারি খাত। কারণ, মুদ্রানীতিতে যেমন সুদহার কমছে না, অন্যদিকে এ খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগের চেয়ে কিছুটা কমিয়ে ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বেসরকারি খাতকে চাঙা রাখতে সুদহার সহনীয় পর্যায়ে রাখার কথা বলছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মুদ্রানীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা, যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। কর্মসংস্থানের পেছনে বড় ভূমিকা রাখে বেসরকারি খাত।
এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও মুদ্রানীতির অন্যতম কাজ। এসব বিষয় মাথায় রেখে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারসহ স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সভায় মুদ্রানীতি অনুমোদন করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের ‘মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট (এমপিএস)’ প্রকাশ করবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে প্রতিবছর দুই দফায় (জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য) মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ সম্পদের পরিমাণ নির্ধারণের রূপরেখা তুলে ধরা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক এবার ‘নিয়মরক্ষার মুদ্রানীতি’ ঘোষণা করতে যাচ্ছে, যেখানে নীতি সুদহার ও বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আগের মতোই অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসায়ীরা এখন নতুন বিনিয়োগে অনাগ্রহী। অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে না নামা পর্যন্ত সুদহার অপরিবর্তিত রাখার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত থাকলেও, এবারের ঘোষণায় বড় কোনো নীতিগত পরিবর্তন থাকছে না। প্রধান লক্ষ্য থাকছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৪ শতাংশ, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
অথচ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯.৮ শতাংশ। এমন বাস্তবতায় ঋণপ্রবাহের বর্তমান ধারা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদিকে, বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্ট’ অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। তবে পরবর্তী দুই অর্থবছরে তা বাড়বে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৪.৯ শতাংশ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৫.৭ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও তা এখনো উচ্চপর্যায়ে রয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৪৮ শতাংশ হয়েছে, যা মে মাসে ছিল ৯.০৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে না নামা পর্যন্ত নীতি সুদহার কমানোর কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৩.৬ শতাংশ। এই ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যাংকের বাইরের উৎস হিসেবে সঞ্চয়পত্র থেকে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৪ হাজার কোটি এবং ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৯ হাজার কোটি টাকা।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সুদহার অনেক বেশি। আবার গত দেড় বছর বিশ^ অর্থনীতিতে একটা টালমাটাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্রাম্পের শুল্কনীতি। চলমান রাজনৈতিক সংকটে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ‘আইসিইউ’তে রয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ ও ব্যাংকিং নানারকম জটিলতার সঙ্গে ভুল নীতিও নেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ বিনিয়োগের চিন্তা করছেন না। নতুন মুদ্রানীতিতে সুদহার কিছুটা কমানো উচিত। তা না হলে বেসরকারি খাতে মন্দা সৃষ্টি হবে।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কে মুজেরী বলেন, নীতি সুদহার কমালেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ খুব একটা ভালো হবে বলে মনে হয় না। কারণ, দেশের অর্থনীতিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ বা উৎপাদনেও আগ্রহী নন।
এত সংকট থাকার কারণে অনেকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সুদহার কমিয়ে কোনো লাভ নেই। তিনি বলেন, শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি খুব একটা কমানো যায়নি। কারণ, মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সরবরাহ ও বাজারব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। তাই এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতি খুব একটা কাজ করে না।
আপনার মতামত লিখুন :