গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ হাজার ৮২৮ কোটি ৩৯ লাখ (৪৮.২৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। এ তথ্য রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি)। অন্যদিকে চলতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট-বিওপি) যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ হাজার ৩৯৫ কোটি ৮০ লাখ (৪৩.৯৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এ হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, ইপিবি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের যে হিসাব দিয়েছে, তার চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ৪৩২ কোটি ৫৯ লাখ (৪.৩২ বিলিয়ন) ডলার কম। অর্থাৎ অর্থবছর শেষ হলেও পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান রয়ে গেছে সেই গরমিল।
জানা যায়, পণ্য রপ্তানির তথ্যে গরমিলের বিষয়টি গত বছরের ৩ জুলাই সামনে এনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, এত দিন ইপিবির পরিসংখ্যান ধরে রপ্তানির হিসাব করা হতো। তবে সে অনুযায়ী দেশে রপ্তানি আয় আসছিল না। এ নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এখন থেকে প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। তখন দেওয়া দুই হিসাবের তুলনা করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির পণ্য রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যানে গরমিল দাঁড়িয়েছিল ১ হাজার ৮১ কোটি (প্রায় ১১ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত সময়ে রপ্তানি আয় হয় ৪ হাজার ৭৩ কোটি (৪০.৭৩ বিলিয়ন) ডলার, যা আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ কম। যদিও ইপিবি দাবি করেছিল, ওই ১১ মাসে (জুলাই-মে) রপ্তানি আয় হয়েছিল ৫ হাজার ১৫৪ কোটি (৫১.৫৪ বিলিয়ন) ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। তবে পরে সংস্থাটি জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (১২ মাসে) ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি (৪৪.৪৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয় ৪০ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। তার মানে ওই অর্থবছরে রপ্তানি আয় বাংলাদেশ ব্যাংকের চেয়ে ৩৬৬ কোটি (৩.৬৬ বিলিয়ন) ডলার বেশি দেখিয়েছিল ইপিবি। সে সময় দেখা যায়, তিন অর্থবছরের ৩৪ মাসে এনবিআরের চেয়ে ২ হাজার ২৬১ কোটি (২২.৬১ বিলিয়ন) ডলারের রপ্তানি আয় বেশি দেখায় ইপিবি। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, ইপিবির তথ্যে একই রপ্তানির পরিসংখ্যান বারবার দেখানোসহ কয়েকটি কারণে আয় বেশি দেখাচ্ছিল।
বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি হয় শুল্কায়নের পর। সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যভান্ডারে তা নথিভুক্ত হয়। স্থানীয় রপ্তানি (দেশের অভ্যন্তরে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও সরঞ্জাম সরবরাহ), নমুনা রপ্তানি ও প্রকৃত রপ্তানি এই তিন ধরনের হিসাব থাকে এনবিআরে তথ্যভান্ডারে। রপ্তানি হওয়া পণ্য থেকে কত আয় দেশে আসে, তার হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া যায়। এনবিআর ও ইপিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এনবিআরের কাছ থেকে হিসাব নিয়ে পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে ইপিবি।
এই পরিসংখ্যানের মধ্যে স্থানীয় রপ্তানি ও নমুনা রপ্তানির হিসাবও থাকে। সেগুলো বাদ দিলে প্রকৃত রপ্তানির তথ্য মিলবে। তবে স্থানীয় রপ্তানি ও নমুনা রপ্তানির আলাদা কোনো কোড না থাকায় সেগুলো আলাদা করতে পারেন না ইপিবির কর্মকর্তারা। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা তখন বলছিলেন, রপ্তানির ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নীতি-নির্ধারকরা যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেগুলো পরে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রপ্তানির হিসাব সঠিক না হলে ভবিষ্যতে এমন সংকট আরও আসবে।
এখন তথ্যে গরমিল থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান। তিনি বলেন, এত কিছুর পরও ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে কেন ব্যবধান হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। এটা মোটেও কাম্য নয়। পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যানের আগের ভুলটি ছিল ইচ্ছাকৃত। এখনো কেন ভুল-ত্রুটি হচ্ছে, সেটি খুঁজে বের করে যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন হওয়া দরকার। মাহমুদ বলেন, পরিসংখ্যান সঠিক না থাকলে নীতি প্রণয়নে ভুল হবে, এটাই বাস্তবতা। ভবিষ্যতে রপ্তানি খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেক নীতিমালা লাগবে, তবে তথ্য পরিসংখ্যান সঠিক না থাকলে সেগুলো যথাযথ হবে না। এমনকি ব্যবসা সম্প্রসারণ ও লক্ষ্য নির্ধারণেও মারাত্মক ভুল হতে পারে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, পণ্য রপ্তানি ও রপ্তানির আয় প্রত্যাবাসনের মধ্যে বড় ব্যবধান এখনো থাকায় সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। ফলে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ রপ্তানি যথাযথভাবে নজরদারি করতে হবে। কোন ক্রয়াদেশের বিপরীতে অর্থ আসছে না, সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে।
জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গাইডলাইন মেনে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান প্রতি মাসে প্রকাশ করছেন। তাহলে গরমিল থাকছে কেন, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, এই রপ্তানির মধ্যে স্থানীয় রপ্তানির হিসাব যুক্ত রয়েছে কি না, সেটি আমরা খতিয়ে দেখব। যদি কোনো ত্রুটি থাকে, তাহলে আমরা অবশ্যই সংশোধনের উদ্যোগ নেব।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন