দেশে দৈনিক ১০ থেকে ২০ কোটি টাকার প্রতারণামূলক লেনদেন হয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ডিবি) মো. ইলিয়াস জিকো। তিনি বলেন, এসব লেনদেনের কারণে সাধারণ মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সন্দেহজনক লেনদেন ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে ফোন কলের মাধ্যমে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি মিলনায়তনে ‘সবার জন্য ডিজিটাল ব্যাংকিং: আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে সেতুবন্ধন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় পুলিশের এই কর্মকর্তা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ডা. মো. এজাজুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ।
ডিএমপির গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের উত্তর বিভাগে কর্মরত ইলিয়াস বলেন, এখন ডিজিটাল লেনদেনকে কেন্দ্র করে একটি চক্র অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এ জন্য বিকাশসহ সব মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিতভাবে গ্রাহকের তথ্য হালনাগাদ করতে বলা হয়েছে। তিন থেকে ছয় মাস অন্তর তথ্য হালনাগাদ করলে প্রতারণা অনেকাংশে কমে আসবে। কারণ দেখা যায়, কারও নামে বিকাশ হিসাব খুলে প্রতারণা হচ্ছে, অথচ প্রকৃত গ্রাহক একজন অজ্ঞাতপরিচয় বৃদ্ধা।
পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক হিসাব খোলার সময়ও ভুয়া তথ্য ব্যবহার করা হয়। কখনো কখনো শাখা ব্যবস্থাপক জড়িত না হলে তথ্যগত ঘাটতি থাকার পরও প্রতারকের নামে হিসাব খোলা সম্ভব নয়। দেখা যায়, কোনো গ্রাহকের এক বছরে লেনদেন নেই, হঠাৎ কয়েক দিনে কয়েক লাখ টাকার লেনদেন হচ্ছে এবং ৩০ মিনিট পরপরই টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। অথচ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ফোনে যোগাযোগ করলে এ ধরনের প্রতারণা সহজেই ঠেকানো যেত।
একটি ঘটনার উল্লেখ করে ইলিয়াস বলেন, হঠাৎ এক গ্রাহকের হিসাবে বিপুল অর্থ জমা হয়। ওই ব্যক্তি তাৎক্ষণিকভাবে সেই টাকা তুলে ফেলেন। পরে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ওই ব্যক্তি প্রতারক। তিনি ব্যাংকে প্রবেশ করেছেন এক চোখ অন্ধ সেজে এবং হাতে ব্যান্ডেজ করে। এভাবেও প্রতারণা হচ্ছে, যা কর্তৃপক্ষের নজরে আনা জরুরি। তিনি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিটি সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর আহ্বান জানান।
স্বাগত বক্তব্যে তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘দেশে ২০১১ সালে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস চালুর পর বর্তমানে প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষ এই সেবা ব্যবহার করছে। তবে সাইবার নিরাপত্তা, ভোক্তাদের অধিকার রক্ষা ও আস্থার ঘাটতির কারণে এই খাতের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে আস্থা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আইসিটি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, সরকারি-বেসরকারি খাত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণে কাজ করছে। তিনি জানান, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় সরকার দ্রুত ডাটা প্রটেকশন অর্ডিন্যান্স প্রণয়ন করছে। সচিব আরও জানান, দেশে ওয়ান-স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে নাগরিকসেবা প্রদান শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ঢাকায় ১০টি নাগরিক সেবা চালু করা হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ডা. এজাজুল ইসলাম জানান, আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৩ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মানি সার্কুলেশন হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকের বাইরে সাধারণ মানুষের হাতে রয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, এখনো দেশের মোট লেনদেনের মাত্র ২৭ থেকে ২৮ শতাংশ ডিজিটাল মাধ্যমে হচ্ছে, বাকি ৭০ শতাংশ প্রথাগত পদ্ধতিতেই সীমাবদ্ধ।
রবি আজিয়াটা পিএলসির হেড অব কমার্শিয়াল পার্টনারশিপ সানজিদ হাসান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে ২০২৫ সালে ডিজিটাল ব্যাংকিং খাতের বাজার ৪৬৭৮ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও ২০৩৩ সালে তা ১১২৩৮ দশমিক ৬ মিলিয়নে পৌঁছাবে। তিনি নিরাপদ লেনদেনের জন্য সমন্বিত সাইবার সিকিউরিটি ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান বলেন, দেশে ৬৪টি ব্যাংক থাকলেও কার্যকর ডিজিটাল ব্যাংক চালুর রোডম্যাপ নেই। সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আজিজুর রহমান জানান, দেশের ৩০-৪০ শতাংশ মানুষ এখনো ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে। ওমেগা এক্সিম লিমিটেডের পরিচালক রেজওয়ান আলী বলেন, রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রমে ব্লকচেইন প্রযুক্তি যুক্ত করা হলে স্বচ্ছতা বাড়বে।
বেটলস্ সাইবার সিকিউরিটি লিমিটেডের চিফ সাইবার অফিসার শাহী মির্জা এজেন্ট ব্যাংকিং কম্পিউটারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি ইউনিফাইড সাইবার সিকিউরিটি ফ্রেমওয়ার্ক গঠনের প্রস্তাব করেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন