ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নেই বেসরকারি মালিকানাধীন এক ডজন ব্যাংকে। এর মধ্যে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে ৯ ব্যাংকের এমডিকে, যাদের ব্যর্থতার কারণে গত সরকারের সময়ে ব্যাংকের মালিকপক্ষ দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে অর্থ লোপাট করেছেন।
এই অভিযোগে তাদের ছুটি থেকে আর না ফেরানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে দুদকসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা তাদের অনিয়ম তদন্ত করছে। এমডির সংকটে জোড়াতালি দিয়ে দুটি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে শীর্ষ নির্বাহী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতি প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক কেলেঙ্কারি, অনিয়ম ও তারল্যসংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। এমডি না থাকায় এসব ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যানরাও ভূমিকা রাখতে পারছেন না।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী, এক্সিম, গ্লোবাল ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, কমিউনিটি, সিটিজেন, ন্যাশনাল, পদ্মা, ওয়ান ও সাউথইস্ট ব্যাংক। বর্তমানে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভারপ্রাপ্ত এমডি বা সিইও হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছেন। তাদের কেউ কেউ চার মাস ধরে এমন দায়িত্ব পালন করছেন। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে এমডি পদে থাকা দক্ষ কয়েকজন ব্যাংকার আগামী এক বছরে বয়সের কারণে বিদায় নেবেন। এ তালিকায় আছেন ব্র্যাক, ডাচ্-বাংলা, এমটিবি ও ইস্টার্ণ ব্যাংকের এমডি।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে যে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে, তার ক্ষত দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। লুটপাটের মাধ্যমে আমানতকারীদের টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের কারণে ব্যাংক খাতকে চারটি মৌলিক সূচকে তীব্র লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, ঋণ বিতরণের সক্ষমতা হ্রাস ও ঋণের প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি, নিট আয় হ্রাস পেয়ে সর্বনিম্নে এবং চাহিদা অনুযায়ী মূলধন রাখার সক্ষমতার তীব্র অভাব।
এই চার খাতে লড়াই করে দুর্বল কিছু ব্যাংক এগিয়ে গেলেও কয়েকটি পারছে না। ফলে এসব ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার চিন্তাভাবনা চলছে। এজন্য নতুন আইনও করা হচ্ছে। মোটাদাগে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে প্রায় ১৫টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ফলে এস আলম, বেক্সিমকো, শিকদার গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের বলয় থেকে মুক্ত হয়েছে ব্যাংকিং খাত। দুর্নীতির দায়ে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে ৯ ব্যাংকের এমডিকে। পদত্যগ করেছেন আরও তিন ব্যাংকের এমডি। ফলে বেসরকারি খাতের মালিকানাধীন এক ডজন ব্যাংকে এখন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নেই। গত চার মাস ধরে ওই সব ব্যাংকে প্রধান নির্বাহী পদ শূন্য রয়েছে।
এমডি না থাকায় এসব ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যানরাও ভূমিকা রাখতে পারছেন না। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী, এক্সিম, গ্লোবাল ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, কমিউনিটি, সিটিজেন, ন্যাশনাল, পদ্মা, ওয়ান ও সাউথইস্ট ব্যাংক। বর্তমানে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভারপ্রাপ্ত এমডি বা সিইও হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছেন।
এদিকে বেসরকারি খাতের আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেডের এমডি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) মো. মজিবুর রহমান। এ ছাড়া গত মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবিরকে ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির কারণে ব্যাংকিং ব্যবসা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে।
এ জন্য এখন সবাই এমডি পদে দক্ষ ব্যাংকারদের পাশাপাশি সুনাম আছে এমন ব্যক্তিদেরই খুঁজছেন। কিন্তু এমন কর্মকর্তা দেশের ব্যাংকগুলোয় খুব বেশি নেই। মোটা অঙ্কের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা এবং ক্ষমতা থাকায় এমডি পদে বসতে অনেকের আগ্রহ থাকলেও সুযোগ পান অল্প কয়েকজন ব্যাংকার। এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এমডিদের মধ্যে বেশির ভাগেরই শুরুটা বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে। পাশাপাশি এখন ডিএমডিদেরও অনেকের শুরুটা বিদেশি ব্যাংকে। তারাও ব্যাংকের শীর্ষ পদে বসতে চান।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভারপ্রাপ্ত এমডি বা সিইও হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছেন। তাদের অনেকেই অনেক যোগ্য। ধাপে ধাপে তারাও এমডি হবেন। বর্তমানে যে সংকট রয়েছে, তা শিগ্গিরই কেটে যাবে বলে আমি মনে করি।
এদিকে আগামী এক বছরের মধ্যে এমডি পদে থাকা অনেক দক্ষ ব্যাংকারই বয়সের কারণে বিদায় নেবেন। এ তালিকায় আছেন ব্র্যাক, ডাচ্-বাংলা, এমটিবি, ইস্টার্ণ ও মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকারদের চাকরির মেয়াদ ৫৯ বছর হলেও এমডিরা সর্বোচ্চ ৬৫ বছর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এমডি হতে ব্যাংকারদের অভিজ্ঞতা থাকতে হয় ২০ বছরের, বয়স হতে হয় ৪৫ বছরের বেশি।
দক্ষ এমডির খোঁজে উদ্যোক্তারা
আগে ব্যাংকের মালিকেরা প্রভাব খাটিয়ে অযোগ্য ও দুর্নীতিতে যুক্ত অনেককে এমডি বানাতে পারলেও এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই অনুমোদন দিচ্ছে না। আগে বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ও বিতর্কিত এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর মতো ব্যক্তিরা এমডি হতে পেরেছেন।
এখন তাদের মতো ব্যাংকারদের ঠেকাতে নতুন নীতিমালা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন এমডি হতে ব্যাংকের ব্যাবসায়িক লক্ষ্য পূরণের নিশ্চয়তা দেওয়া ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গিয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হচ্ছে। আর প্রতিবার নিয়োগের মেয়াদ হচ্ছে তিন বছর। আগে একবারে পাঁচ বছরের নিয়োগ অনুমোদন করত বাংলাদেশ ব্যাংক।
নতুন মুখ আসবে যেসব ব্যাংকে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি। তিনি ২০১৬ সালে ব্যাংকটির এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেন। মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি আহসান-উজ জামান তার মেয়াদ শেষ করবেন একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি, তিনি ২০১৪ সাল থেকে একই পদে আছেন। ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ৪ মার্চ।
তিনি ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্সের এমডি ছিলেন। একই মাসে এমডি পদে যোগ দেন ব্র্যাক ব্যাংকে। ইস্টার্ণ ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার আগামী বছরের ১৯ এপ্রিল মেয়াদ শেষ করবেন। তিনি ২০০৭ সাল থেকে এই পদে আছেন।
জানতে চাইলে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, ‘এমডি হিসেবে সামনের বছরে আমার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তার আগে ব্যাংকটিকে আরও গুছিয়ে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে যেতে চাই।’