ঢাকা শুক্রবার, ০১ আগস্ট, ২০২৫

১০ কোটি টাকা প্রকল্পের নির্মাণকাজ অনিশ্চিত, লাপাত্তা ঠিকাদার

খোরশেদ আলম রাজু, নওগাঁ
প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২৫, ১০:৪৮ পিএম

উত্তরাঞ্চলের খাদ্যশস্যে সমৃদ্ধ জেলা নওগাঁ। আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার (সাইলো) নির্মাণের মাধ্যমে এই সম্ভাবনাকে আরও বেগবান করার লক্ষ্যেই মহাদেবপুর উপজেলায় প্রায় ১০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রকল্প শুরুর কয়েক মাস পর থেকেই অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। এখন সেটি অনিশ্চয়তার মুখে।


২০২৩ সালের ৫ আগস্টের পর মাটি ভরাট অসমাপ্ত রেখেই গা ঢাকা দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ফলে সাইলো নির্মাণের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পটি অপ্রয়োজনীয় ছিল এবং এটি সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ব্যক্তিস্বার্থে নেওয়া হয়েছিল। আর সাইলোটি নির্মিত হলে উত্তরাঞ্চলের শস্যভান্ডার খ্যাত জেলার ১১টি উপজেলাসহ আশপাশের জেলায় উৎপাদিত উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য সরকারিভাবে সংগ্রহ করা সহজ হবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


স্থানীয়রা জানান, খাদ্যশস্যে উদ্বৃত্ত উত্তরের বৃহৎজেলা নওগাঁয় খাদ্যশস্য সংরক্ষণে ২০টি খাদ্যগুদাম রয়েছে। যার ধারণক্ষমতা ৫৮ হাজার ৪৭৫ টন। এরমধ্যে অধিকাংশ খাদ্যগুদাম বছরের বেশিরভাগ সময় ফাঁকা থাকে। এরপরও ৪৮ হাজার টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন খাদ্য সংরক্ষণাগার (সাইলো) নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।


খাদ্য বিভাগের তথ্যমতে, স্টিল-নির্মিত এই সাইলোর ধারণক্ষমতা হবে ৪৮ হাজার টন। মাটি ভরাটের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, আর পুরো প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১০ কোটি ৫৬ লাখ ৭১ হাজার টাকা। প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নের জন্য যৌথভাবে কার্যাদেশ পেয়েছে ঢাকার মেসার্স চন্দ্রদ্বীপ কনট্রাকশন, রাজশাহীর মেসার্স ডন এন্টারপ্রাইজ ও নওগাঁর মেসার্স ইথেন এন্টারপ্রাইজ। গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ভূমি উন্নয়ন কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও লাপাত্তা হয়ে যায় ঠিকাদার।
জানা যায়, ২০২২ সালের শেষ দিকে নওগাঁ-রাজশাহী আঞ্চলিক মহাসড়কের পশ্চিম পাশে জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর এলাকায় খাদ্য সংরক্ষণাগার (সাইলো) নির্মাণের জন্য ১৫ একর (৪৫ বিঘা) জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এরপর মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। মাটি ভরাটের কাজ ৯৫ শতাংশ হলেও প্রায় ৩ বছর ধরে প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। যেখানে স্থানীয়দের গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে গাঢাকা দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও। এরপর থেকে সাইলো নির্মাণের কাজটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সাইলোটি আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।


উপজেলার নওহাটা এলাকার বাসিন্দা শাহজাহান বলেন, জেলায় পর্যাপ্ত খাদ্যগুদাম আছে এবং সংরক্ষণ করা যায়। তারপরও তৎকালীন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে সাইলোটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এখানে সাইলো প্রকল্পটি দেখিয়ে অনেকের চোখে ধুলো দিয়ে তার নিজের প্রত্যন্ত এলাকায় নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছিল। বর্তমানে সাইলো প্রকল্পটির কাজ বন্ধ রয়েছে। আদত সাইলো হবে কিনা তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। তবে সাইলো যদি না হয় সেখানে অন্য যেকোনো উন্নয়ন কাজে জায়গাটি ব্যবহার করা হোক।


জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি এসএম আজাদ হোসেন মুরাদ বলেন, প্রকল্পটির কাজ সম্পূর্ণ না হলেও মাটিভরাটের কাজ প্রায় শেষ। এই বড় পরিসরের জায়গাটি পতিত না রেখে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মৌসুমি ফসল হিসেবে ফলজ বা খাদ্যশস্য উৎপাদন করা যেতে পারে। এতে করে খাদ্য যোগানের পাশাপাশি সমৃদ্ধ হবে অর্থনীতি।


ভীমপুর গ্রামের আরমান আলী অভিযোগ করে বলেন, তিন ফসলি জমিকে এক ফসলি দেখিয়ে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আবার ভরাটের সময় বালুর পরিবর্তে এঁটেল মাটি ব্যবহার করা হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।


একই গ্রামের আব্দুল মান্নান বলেন, সাইলো নির্মাণ হবে গত ৩ বছর থেকে এই কথা শুনে আসছি। এজন্য মাটিও ভরাট করা হয়েছে। এতে খাদ্যশস্য সংরক্ষণ হবে এবং এলাকার উন্নয়ন হবে। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে কাজ বন্ধ রয়েছে। সেখানে গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে এবং ফুটবল খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাইলো হবে কিনা তা আমরা বুঝতেও পারছি না।


নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চাকদার বলেন, এ জেলায় প্রায় ২৭ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়। সরকারিভাবে খাদ্যশস্য সংগ্রহের সময় জেলার খাদ্যগুদামগুলো খালি করে সংগ্রহ করতে হয়। পাশের বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার (সাইলো) ও কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদাম (সিএসডি)সহ চারটি খাদ্যশস্য সংগ্রহ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করতে হয়। এতে ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ। এ কারণে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ধান-চালের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সাইলো নির্মাণ প্রয়োজন।


নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. ফরহাদ খন্দকার বলেন, সাইলো নির্মাণে মাটি ভরাটের কাজ ইতোমধ্যে ৯৫ শতাংশ  শেষ হয়েছে। কাজের এখনো ১০ শতাংশ টাকা জামানত হিসেবে রক্ষিত রয়েছে। তবে অজ্ঞাত কারণে ঠিকাদার কাজ বন্ধ রেখে লাপাত্তা। গত ৫ আগস্টের পর থেকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে তা অধিদপ্তর ভালো বলতে পারবেন। তবে খালি জায়গায় ফলজ গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবং জেলায় সংরক্ষণ ব্যবস্থার নিশ্চয়তা আছে।