বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও লন্ডন বিএনপির সভাপতি এম এ মালিক। বিগত চার যুগের বেশি সময় থেকেই বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়। আওয়ামী লীগের দমন-নিপীড়ন আর ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের সংগ্রামী মুখ।
লন্ডন বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন দীর্ঘদিন থেকেই। দেশের বর্তমান রাজনীতি, সংস্কার, বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, আগামী নির্বাচনসহ সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে তিনি মুখোমুখি হয়েছেন রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে। গুলশানের একটি বাসায় তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রূপালী বাংলাদেশের সম্পাদক ও প্রকাশক মো. সায়েম ফারুকী এবং সিনিয়র রিপোর্টার সেলিম আহমেদ
রূপালী বাংলাদেশ: বিএনপির রাজনীতিতে আপনার যাত্রা কীভাবে?
এম এ মালিক: ছাত্রজীবনেই ১৯৭৫ সালে আমি জাতীয় তরুণ সংঘ নামে একটি সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। ওই সংগঠন তৎকালীন সময়ে খুবই জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ছিল। সারা দেশে সংগঠনটির সাড়ে সাত লাখ সদস্য ছিলেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকার হাজারীবাগের মানিক বাবুর ঢালে জাতীয় তরুণ সংঘের জাতীয় সম্মেলনে সিলেট জেলার সভাপতি থেকে আমাকে আন্তর্জাতিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ওইদিন আমি সিলেটের পক্ষ থেকে বক্তব্যও দিয়েছিলাম। এরপর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ডাকে ১৯ দফা কর্মসূচিতে আমরা তরুণ সংঘের পক্ষে কাজ করেছি। জিয়াউর রহমান প্রথমে জাগদল গঠনের পর তিনি সিলেটের সমাবেশে গেলে আমি দলটির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করি। এরপর বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হই। এ ছাড়া ইয়ুথ হিসেবে দেশে-বিদেশে নানা কর্মশালায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি। রাজনীতি ও সামাজিক কার্যক্রম একসঙ্গেই করেছি।
রূপালী বাংলাদেশ: দেশের গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লন্ডনে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম যেভাবে করেছেন...
এম এ মালিক: স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আমরা লন্ডনে আন্দোলন করেছি। ইস্ট লন্ডনে তখন সাত দলের পক্ষে আমরা তখন একটি সেমিনার করে জনমত তৈরি করেছি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা গণতন্ত্রের মাতা বেগম খালেদা জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন। আমরা লন্ডনে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। সাত দিন লন্ডনের মতো জায়গায় শেখ হাসিনাকে অবরোধ করে রেখেছিলাম। আমরা লাখো বাংলাদেশি মার্চ করে তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলাম। ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ ৭০০ জাতীয় নেতা যখন গুম হয়ে যায়, তখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া ওয়ান-ইলেভেনের সময় মঈনবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে ছিল, তখন কানাডায় ১৮ জন এমপির সঙ্গে বৈঠক করেছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে কথা বলেছি। জাতিসংঘে একাধিকবার বক্তব্য রেখেছি। আমার ছেলে একজন আইনজীবী, তাকেও একবার নিয়ে গিয়েছি। আমাদের দলের একাধিক নেতাকর্মী নানাভাবে কাজ করেছেন। আমরা বিদেশে থাকলেও বাংলাদেশের সুখে আমরা আনন্দিত হই, বাংলাদেশের দুঃখে আমরা কান্না করি।
রূপালী বাংলাদেশ: দেশের রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের পথ কী হতে পারে?
এম এ মালিক: রাজনৈতিক যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার পেছনে প্রধান ভূমিকা ভারতের। ভারতের ‘র’ এবং আওয়ামী লীগের দেশের বাইরে পাচার করা টাকা দিয়ে দেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে। এখনো ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ৮০ শতাংশ উত্তরসূরি ব্যুরোক্রেসিতে রয়ে গেছে। তারা বিগত ১৫ বছর আমাদের রক্ত চুষে খেয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভালো মানুষ। কিন্তু তার পক্ষে তাদের সঙ্গে একা লড়াই করা সম্ভব নয়। এ জন্য তারেক রহমানও বলেছেন, ড. ইউনূসকে সাহায্য-সহায়তা করতে। তিনিও করছেন। এখন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে একটি সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হবে। ক্ষমতাসীন সরকারের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকতে হবে। তাহলে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।
রূপালী বাংলাদেশ: প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে ফ্যাসিস্টের অনেক দোসর রয়ে গেছে। তারা ভোটের সময় দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে?
এম এ মালিক: চাকরিতে যোগদানের সময় সবাই অঙ্গীকার করেন ‘আমি যা করব রাষ্ট্রের পক্ষে করব। আমার ব্যক্তিগত কোনো এজেন্ডা থাকবে না। কোনো গোষ্ঠী বা দলের পক্ষে কাজ করব না।’ যদি তারা তাদের এই অঙ্গীকার থেকে স্টেপ ডাউন না হয়, তাহলে আমার মনে হয় নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। আর কেউ যদি মনে করি আমি গোপালি পুলিশ, আমি হাসিনার জন্য কাজ করব, তাহলে সে ‘যারজ’। প্রশাসনে থাকা সবাই শিক্ষিত ও স্মার্ট আশা করছি, শপথের বিরুদ্ধে যাবে না।
রূপালী বাংলাদেশ: অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কতটা সংস্কার করা সম্ভব হবে?
এম এ মালিক: সরকার যে সংস্কারকাজ করছে, সেটা ভালো করছে। সরকার যদি শেখ হাসিনার বিচার করতে পারে, বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে পাওে, তাহলে দেশের জন্য মঙ্গল। ড. ইউনূস ভালো মানুষ, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তার পক্ষে এসব কাজ করা অনেকটা সম্ভব। সংস্কারে এই সরকারের যেসব অসম্পূর্ণ কাজ থাকবে, তা পরবর্তী নির্বাচিত সরকার কন্টিনিউ করবে।
রূপালী বাংলাদেশ: বর্তমান সরকার শেখ হাসিনা ও সহযোগীদের বিচারকাজ শেষ করতে না পারলে পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার কি সেই বিচারকাজ সম্পন্ন করবে?
এম এ মালিক: অবশ্যই এই বিচারকাজ করতে হবে। আমি মনে করি, ড. ইউনূস সরকারের কেবিনেটের প্রতি কোনো সময় অশ্রদ্ধাশীল হব না। আমরা আনগ্রেটফুল হব না। ড. ইউনূসকে তারেক রহমান পরিষ্কার বলেছেন, আমরা সহযোগিতা করতে চাই, সহযোগিতা করছি।
আওয়ামী লীগ আমাদের মাতৃভূমির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। বিডিআর হত্যার বিচার হয়নি, তাদের বিচার হতে হবে। সাগর-রুনি হত্যার বিচার হতে হবে। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে, স্বাধীন দেশে আয়নাঘর ছিল না। তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হাজার রাউন্ড গুলি করে হেফাজতকে হত্যা করা হয়েছে। এবার কোটা নিয়ে হাজার হাজার কোমলমতি শিক্ষার্থীর ডিমান্ড ছিল খুবই সামান্য ও যুক্তিসংগত। কিন্তু তাদের পাখির মতো হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনার বিচার হওয়া উচিত।
রূপালী বাংলাদেশ: বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামী। লম্বা সময় একসঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা দিয়েছে দূরত্ব। এই দূরত্বের কারণ কী?
এম এ মালিক: বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব আমি দেখি না। জামায়াত করে জামায়াতের রাজনীতি, বিএনপি করে বিএনপির রাজনীতি। জামায়াতের সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলন করেছি। জামায়াতের আমির খালেদা জিয়াকে দেখতে গিয়েছেন। ভালো সম্পর্ক না থাকলে কেউ কি কাউকে দেখতে যায়। আর তারেক রহমান বলেছেন, আমরা যখন সরকার গঠন করব, যুগপৎ আন্দোলন যারা করেছেন, তাদেরও নেব।
রূপালী বাংলাদেশ: তারেক রহমান দেশে ফিরবেন কবে?
এম এ মালিক: তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে ঈদের পর একটি সিদ্ধান্ত আসবে। কারণ হুট করে তার আসাটা ঠিক হবে না। নির্বাচনের একটা রোডম্যাপ ঘোষণা হলেই তিনি আসবেন। ঈদের পর তিনি বিষয়টি ক্লিয়ার করবেন।
রূপালী বাংলাদেশ: মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের সহযোগিতার সেই মূল্যায়ন কি করা হয়েছে?
এম এ মালিক: মুক্তিযুদ্ধের সময় বিট্রিশরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা করেছে। অস্ত্র কিনে দিয়েছে, খাবার কিনে দিয়েছে। কিন্তু এসব কথা কেউ বলে না। সবাই ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া করে। আওয়ামী লীগ অনেক হারামি। তারা বিশ্বাসঘাতক। ইন্ডিয়া আমাদের সহযোগিতা করেছে ঠিকই, কিন্তু আমরা তাদের হোটেল হিসেবে ব্যবহার করেছি। ভারতের হোটেলে থেকে টাকা দিয়েছি। ইন্ডিয়া তো বিনা মূল্যে সহায়তা করেনি। তারা যুদ্ধের সময় আমাদের ব্যবহার করা অস্ত্র, পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র, উড়োজাহাজ, যুদ্ধসরঞ্জাম সবই নিয়ে গেছে। এখন আমরা যখন দেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করি, তখন দলটির সভানেত্রী স্বৈরাচার হাসিনাসহ তার পরিবার ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আবার ভারতে আশ্রয় দিয়েছে। সেখান থেকে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
রূপালী বাংলাদেশ: টিউলিপের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে ব্রিটিশ সরকার?
এম এ মালিক: টিউলিপ ইজ এ ক্রিমিনাল। টিউলিপ একটা দেশের এমপি ও মন্ত্রী। তাকে বাংলাদেশি ও ব্রিটিশরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। কিন্তু সে লোভী হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। ভারতের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে। সে রাশিয়ায় হাসিনার সঙ্গে আর্মস ডিল করেছে। রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুই বিলিয়ন ডলার সে এককভাবে কমিশন নিয়ে গেছে। ব্রিটিশ সরকার তাকে বরখাস্ত করেছে। তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার তদন্ত করছে। একসময় তাকে এমপি থেকে বরখাস্ত করা হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: তারেক রহমানকে আপনি দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখছেন। একজন নেতা হিসেবে তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এম এ মালিক: তারেক রহমান বিগত ১৫-১৬ বছর দলকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছেন। গ্রামে গেলেও তারেক রহমানের একটা পোস্টার পাওয়া যায়। আমি মনে করি, এই যুগের ‘কার্ল মার্ক্স’ তারেক রহমান। তার ডায়নামিক লিডারশিপ, দিকনির্দেশনা, চিন্তাধারা, তার বক্তব্যগুলো অনেক বিনয়ী। সময়োপোযোগী সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
রূপালী বাংলাদেশ: জোবাইদা রহমান বিগত দিন নেপথ্যে থেকে দল ও দলের নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আগামী দিন তিনি কি দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন?
এম এ মালিক: ডা. জোবাইদা রহমান হলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলীর মেয়ে। তার মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু হলেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সমাজসংস্কারক। ডা. জোবাইদা তারেক রহমানের স্ত্রী। তিনি একজন কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ। তার দেশি-বিদেশি অনেক ডিগ্রি রয়েছে। তাদের মেয়ে জায়মা রহমানও একজন ব্যারিস্টার। বিগত দিনে ডা. জোবাইদা রহমানকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছিল। আমরা মনে করেছি, উনি ভবিষ্যতে দল এবং বাংলাদেশের অনেক কাজ করবেন। একজন ডাক্তার হিসেবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টর নিয়ে উনি কাজ করবেন। তবে রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন কি না আমার জানা নেই। বিষয়টি তিনি নিজে, আমাদের দলের চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জানেন। এর বাইরে কেউ এই বিষয়ে বলতে পারবেন না।
রূপালী বাংলাদেশ: আপনি কোন আসন থেকে নির্বাচন করবেন? প্রস্তুতি কেমন?
এম এ মালিক: আমাকে ম্যাডাম খালেদা জিয়া বলেছেন, মানুষের সেবা করার জন্য দেশে চলেন। আমিও চলে এসেছি। আমার আসন সিলেট-৩ আসন (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ)। আমি এলাকায় গিয়েছি, এলাকার মানুষ চায় আমি নির্বাচনে আসি। তাদের ভালোবাসা আমি দেখেছি। দল যদি মনোনয়ন দেয় আমি নির্বাচন করব।
আপনার মতামত লিখুন :