ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ জুন, ২০২৫

আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন মেরূকরণ

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন
প্রকাশিত: জুন ১, ২০২৫, ০৯:৫৮ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

রিমান্ডে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ে ভেতরের লোমহর্ষক ও ভয়ংকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। এই শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারে রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলছে নতুন মেরুকরণ। ৫ আগস্টের পর জেল থেকে বের হয়ে এবং দেশে প্রবেশ করে নতুন করে রাজত্ব শুরু করেছেন তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। এলাকা দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অপরাধের মাত্রা ভয়াবহ পরিমাণে বেড়েছে।

এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী এলাকায় একক রাজত্ব করতে চাচ্ছেন, অপরদিকে একসময়ে এসব সন্ত্রাসীর নির্দেশে যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে এসেছেন, তারাও এলাকার কর্তৃত্ব ছাড়তে নারাজ। দখল, চাঁদাবাজি, খুনোখুনি, ভাড়ায় খাটা, আধিপত্যের লড়াইসহ নানা অপকর্মের মাঠ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রক তারাই।

এসব নিয়ে চরম অস্থিরতা চলছে ঢাকার অপরাধ জগতে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময়ে দলছুট ক্যাডারদের কাছে টেনে নিচ্ছেন ৫ আগস্টের পর মুক্তি পাওয়া ও দেশে ফিরে আসা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা, চাঁদার ভাগ বাড়ানো ও এলাকার নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়াসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে তুলে দেওয়ারও প্রলোভন দেখানো হচ্ছে।

সম্প্রতি কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে থাকা দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ জিজ্ঞাসাবাদে এমনই চাঞ্চ্যকর তথ্য দিচ্ছেন। যার সত্যতা পাওয়ার পর দেশে অবস্থানরত কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে আমাদের দুই ধরনের পুলিশিং ব্যবস্থা চলমান আছে। আমরা গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছি। এ ব্যাপারে নানামুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতার বিষয়টি সামনে এসেছে। এ ছাড়া বাইন ও মাসুদের কাছ থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ওইসব তথ্য যাচাইয়ের পর দ্রুতই অ্যাকশনে যাবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শীর্ষ সন্ত্রাসী আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু, আরমান ও শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম কারাগার থেকে মুক্তি পান। আর মোল্লা মাসুদ ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরেন আমিন রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর। এরপরই তারা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। জেলে থাকা অবস্থায় যেসব ক্যাডার তাদের কথামতো চলত এবং চাঁদার টাকা তুলত, তাদের ডাকা হয় এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর ডেরায়। এরপর তাদের কাছে এলাকাভিত্তিক টাকা আদায়ের তালিকা চাওয়া হলে অনেকে বেঁকে বসেন। তারা আগের মতো চাঁদার ভাগ দিতে রাজি হলেও এলাকার পুরো নিয়ন্ত্রণ দিতে অনেকে অস্বীকার করেন।

এ নিয়ে অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে তাদেরই পালিত ক্যাডারদের মনোমালিন্য হয়। বিষয়টি মাথায় নিয়ে অনেকে দল পুনর্গঠনে হাত দিয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রুপ-উপগ্রুপের তৎপরতা শুরু হয়। এরপরই আন্ডারওয়ার্ল্ডে শুরু হয় অস্থিরতা।

শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ ও ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল গ্রুপের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির খবর বারবার সামনে আসে। এরপর সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে এখনো কোনো অভিযোগ ওঠেনি।

একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, তিনি আর অপরাধের সঙ্গে জড়িত নয়, তার কেউ অপকর্ম করলে দায় তার নেই। বর্তমানে তিনি বাসায় অবস্থান করছেন। এখন পর্যন্ত পরিবারের সদস্য ছাড়া কারো সঙ্গে দেখাও করেননি। এমনকি কোনো ধরনের যোগাযোগ মাধ্যমও ব্যবহার করেন না বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে।

সূত্র মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে লুট হওয়া অনেক অত্যাধুনিক ও ক্ষুদ্র অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। অনেক সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধানরা এসব অস্ত্র তাদের হেফাজতে রেখেছে এবং চাহিদামতো কিছু অস্ত্র নিজেদের ক্যাডারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। অস্ত্রের লোভ দেখিয়ে উঠতি ক্যাডারদের নিজেদের দলে ভেড়ানো হচ্ছে।

কারণ উঠতি বয়সিদের কাছে দামি ও অত্যাধুনিক অস্ত্র সোনার হরিণের মতো। এমন প্রলোভনে পড়ে অনেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এরপর ওইসব ক্যাডারকে কিছু মিশন দিয়ে মাঠে পাঠানো হচ্ছে। মিশন সফল হলে তবেই তাদের অস্ত্র ও এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করা হচ্ছে।

অপরদিকে, দীর্ষদিন ধরে মাঠ দখলে রাখা ক্যাডাররাও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মরিয়া। তারাও উঠতি বয়সিদের হাতে ধারালো ও ক্ষুদ্র অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে ও আতঙ্ক বাড়াতে কোপাকুপি এবং বোমাবাজির ঘটনাও ঘটাচ্ছেন। অনেকে আবার বিভিন্ন দলের কর্মী-সমর্থক ও নেতা দাবি করেও এলাকায় নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছে বিভিন্ন থানা পুলিশ এবং যৌথ বাহিনী। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কিশোর গ্যাংসহ ছিঁচকে অপরাধীদের। তবে আড়ালে থেকে যাচ্ছে নেপথ্যের নায়করা।

সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়া থেকে দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর গ্রেপ্তার এড়াতে তারা পুরোনো ডেরা পাল্টে উঠছেন নতুন ডেরায়। কেউ কেউ দেশ ছাড়ারও পরিকল্পনা করছেন।

শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলাল ও ইমন মালয়েশিয়ায় পালিয়ে গেছেন। মালয়েশিয়া থেকেই রাজধানীর ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, এলিফেন্ট রোড ও হাজারীবাগ এলাকায় নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী চালাচ্ছেন ইমন। আর মোহাম্মদপুর ও আশপাশ এলাকায় নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন পিচ্চি হেলাল।

ইতিমধ্যে দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনিতে জড়িতের অভিযোগে ইমন, পিচ্চি হেলাল এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও জিডি হয়েছে। ইমন বাহিনীর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড জাহিদ হোসেন ওরফে চাচা জাহিদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে নিউমার্কেট এলাকায় তৎপর রয়েছেন। ক্ষমতার পালাবদলের পর এই জাহিদ হোসেন নিউমার্কেট এলাকার একটি মার্কেট কমিটির নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।

রাজধানীর শেরেবাংলানগরের হাসপাতালকেন্দ্রিক এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছেন পিচ্চি হেলালের অন্যতম সহযোগী যুবদল নেতা জাহিদ মোড়ল। আদাবর থানা বিএনপি নেতা লেদু হাসানের সঙ্গেও পিচ্চি হেলালের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।

আগস্টে জামিনে মুক্তি পাওয়া এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও পিচ্চি হেলাল ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই তাদের বাহিনীর মধ্যে আধিপত্যের লড়াই চলে আসছে। তবে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই দুই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তবে গোয়েন্দাদের একটি সূত্র মতে, অন্তত ৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যেকোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে। সম্প্রতি রাজধানীতে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পেছনে তাদের ইন্ধন পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, গত দুই মাসে রাজধানীতে তিনটি খুন, দখল, চাঁদাবাজি এবং হামলার ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ ও বিকাশের নাম আসে। বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপির নেতা কামরুল আহসানকে (সাধন) গুলি করে হত্যার পেছনেও শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের নাম সামনে আসে। এর আগে ১৯ এপ্রিল হাতিরঝিলে ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ শিকদারকে গুলি ও ছুরিকাঘাতে হত্যার পেছনেও সুব্রত বাইনের সম্পৃক্ততা পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

যুবদলের সদস্য আরিফ সিকদার ছিলেন দুবাইয়ে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ঘনিষ্ঠ। মগবাজার, রামপুরাসহ আশপাশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জিসানের সঙ্গে সুব্রত বাইনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয় অতিসম্প্রতি। আরিফ শিকদার জিসানের পক্ষ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছিলেন। সুব্রত বাইন মগবাজারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তার হয়ে কাজ করার নির্দেশ দেন।

কিন্তু নির্দেশ অমান্য করার পরপরই সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের নির্দেশে আরিফকে হত্যা করা হয় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে। এ ঘটনার কিছুদিন আগে ১৩ মার্চ মগবাজারের ওয়্যারলেস রেলগেটের পাশে একটি ক্লাব ঘরের ভেতরে কুপিয়ে ও মাথা থেঁতলে দেওয়া হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য মো. রাজনকে।

পরে চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে ফেরেন তিনি। এ ঘটনায়ও সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশ। এরপর অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন তারা। এরপর এলাকায় ক্যাডার বৃদ্ধি ও অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়াতে তারা ঢাকা ছেড়ে কুষ্টিয়ায় চলে যান। সেখান থেকে অস্ত্র সংগ্রহের পর তা ঢাকায় পাঠান। গত মঙ্গলবার ভোরে কুষ্টিয়ার সোনার বাংলা রোডের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পরে তাদের দেওয়া তথ্য মতে সকাল ৭টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হচ্ছেন শুটার আরাফাত ও শরীফ। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ৫টি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি ও ১টি স্যাটেলাইট ফোন উদ্ধার করা হয়। অস্ত্রগুলো মগবাজার, শাহবাগ, গুলশান ও বাড্ডা এলাকার সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল।

ওইসব সন্ত্রাসী ৫ আগস্টের পর বাইন ও মাসুদের দলে যোগ দেয়। এলাকাভিত্তিক ওইসব সন্ত্রাসীর তালিকাও অনেক বড়। তবে তাদের নাম পুলিশের খাতায় নেই। এ কারণে গোয়েন্দারা অনেকেই বিস্মিত হন। তারা সবাই উঠতি বয়সি এবং এলিট শ্রেণির বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান।