যশোরের মনিরামপুরের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. ওয়ালিউল্লাহ খান চাকরিজীবন শেষ করে অবসরে গেছেন ২০২২ সালে। পরের বছর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কল্যাণ ও অবসর ভাতার জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। কিন্তু এখনো ভাতা পাননি তিনি। কবে ভাতা পাবেন সেই নিশ্চয়তাও দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
ওয়ালিউল্লাহ খান বলেন, অবসরের পর নানা রোগবালাই শরীরে বাসা বেঁধেছে। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারছি না। অসুস্থতা বিবেচনা করে অন্তত কল্যাণের টাকাগুলো দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি।
একই অবস্থা ছাতকের স্কুলশিক্ষক মো. মাসুদ আহমদেরও। তিনিও ২০২৩ সালের শেষ দিকে কল্যাণ ও অবসর ভাতার জন্য আবেদন করলেও এখনো টাকা পাওয়া দূরের কথা জীবনদ্দশায় সেই টাকা পাবেন কি না তা নিয়ে রয়েছেন চিন্তায়। শুধুু ওয়ালিউল্লাহ কিংবা মাসুদ আহমদ নন তাদের মতো ৮৭ হাজার ৬০০ জন প্রার্থী কল্যাণ ও অবসর ভাতার জন্য ঘুরছেন নীলক্ষেতের ব্যানবেজ অফিসের নিচতলায় কল্যাণ ও অবসর বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দরজায় দরজায়।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তাদের ভাষ্য, মূলত তহবিল-সংকটের কারণে নিয়মিত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরককারীন প্রাপ্য ভাতা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার এ সংকট মেটাতে দুই দপ্তরকে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকার বন্ড কিনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের অনুকূলে ২০০০ কোটি টাকা (বন্ড হিসেবে) এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের অনুকূলে (বন্ড হিসেবে) ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ অর্থ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ শিক্ষকদের অবসর ভাতা পরিশোধে ব্যয় হবে। কিন্তু এই বিশাল অংকের টাকা দিলেও তা দিয়ে সংকট কোনোভাবেই নিরসন হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, বন্ড হিসেবে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও এতে সহসাই তেমন কোন সুফল মিলবে না। কারণ বন্ডের অর্থ থেকে ৬ মাস পর পর লভ্যাংশ পাওয়া যাবে ২২০ কোটি টাকার মতো। যা প্রতি বছরের ঘাটতির তুলনায় যৎসামান্য। প্রতিদিনই অনিষ্পন্ন আবেদনের সংখ্যা বাড়ছে। এ সমস্যা সমাধানে এককালীন বিশেষ থোক বরাদ্দ ছাড়া এই জট নিরসন করা সম্ভব নয়।
এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের ১৯৯০ সাল থেকে কল্যাণ ট্রাস্টের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে অবসর সুবিধা দেওয়া। এই দুই সুবিধা বাবদ শিক্ষকেরা চাকরিকাল অনুযায়ী এককালীন অর্থ পান।
সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন ৫ লাখের বেশি। আইন অনুযায়ী, শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) থেকে চাঁদা হিসাবে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কেটে রাখা হয়। এর মধ্যে অবসর সুবিধা বোর্ড ৬ শতাংশ এবং কল্যাণ ট্রাস্ট ৪ শতাংশ পায়। এর বাইরে বিশেষ বা থোক বরাদ্দ এবং বিভিন্ন সময়ে সরকারের দেওয়া সিড মানি বা গচ্ছিত অর্থের লভ্যাংশ পায় সংস্থা দুটি।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ২২ মে পর্যন্ত ৪২ হাজার ৬০০টি আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে। এসব আবেদন নিষ্পত্তি অথবা পরিশোধ করতে প্রয়োজন ৩ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড থেকে জানা যায়, ২২ মে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪৫ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের (পরিচালক) অধ্যাপক মো. জাফর আহম্মদ বলেন, আশা করছি দ্রুত বন্ড কেনার কার্যক্রম শেষ হবে। এরপর এ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ অবসর ভাতা দেওয়ায় কাজে ব্যয় হবে।