ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন, ২০২৫

রাজনীতিতে ঐকমত্যের পথে বড় বাধা সংস্কার ও নির্বাচন

সেলিম আহমেদ ও এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২৫, ০৩:৪৯ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে বিচার কার্যক্রম ও জুলাই সনদ তৈরিসহ নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। কেউ কেউ জুলাই সনদকে জাতীয় সনদে নামকরণ করার দাবি জানাচ্ছেন। তবে বিপত্তি দেখা দিয়েছে সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই চাচ্ছে সংস্কার ও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ। কিন্তু সরকার এখনো সংস্কার ও নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ সুস্পষ্ট করছে না। তারা বলছে, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির একমাত্র পথ রোডম্যাপ। বিচার একটি চলমান প্রক্রিয়া। জুলাই সনদের বিষয়েও সবাই একমত। নির্বাচন ও সংস্কারের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলেই সবার মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হবে। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ভয়-ভীতি তৈরি হয়েছে সেটা কেটে যাবে। 

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কার্যক্রম শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার কথা। অবশ্য ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে কমিশন। 

বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সভায় নিজেদের মত ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। এর মধ্যে বিচার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হলেও সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে বেধেছে বিপত্তি। কারণ এই দুই ইস্যুতে মতানৈক্য রয়েছে অনেক দলের মধ্যে। বিচার ইস্যুতে ঐকমত্যের অন্যতম কারণ হলো, বিচার চলমান প্রক্রিয়া। এর জন্য কোনো টাইমফ্রেমের প্রয়োজন নেই। বিচারকাজ শুরু হয়েছে যত দিন পর্যন্ত সব বিচার শেষ হবে না তত দিন তা চলমান থাকবে। এ ছাড়া জুলাই সনদ ইস্যুতে অধিকাংশ দলই একমত হয়েছে। তবে গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ভবিষ্যতে সংকট তৈরির আশায় জুলাই সনদকে জাতীয় সনদে নামকরণের দাবি করছে। এনসিপি জুলাই মাসেই জুলাই সনদ ঘোষণার দাবি করছে।

জুলাই সনদ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের হাতে সময় খুবই কম। কমিশনের মেয়াদ ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু আমরা জুলাই মাসের মধ্যেই জুলাই সনদ তৈরি করতে সচেষ্ট। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে জুলাই সনদ ঘোষণা করা হবে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলোর মতো নানা ইস্যুতে ঐকমত্য তৈরি হলেও নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে দেখা দিয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। এসব ইস্যুতে অনেক দলই একে অপরের বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছেন। সরকার নানা চেষ্টা করেও নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে তৈরি হওয়া সংকট কোনোভাবেই কাটাতে পারছে না। রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার এই দুই ইস্যুতে এখন পর্যন্ত কোনো রোডম্যাপ পরিষ্কার করেনি। যদিও সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এর মধ্যে সংস্কার শেষ হবে। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক দলগুলো ভরসা রাখতে না পারায় এই সংকট ক্রমেই বাড়ছে এবং সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বাড়ছে বলে দাবি তাদের। 

বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই দাবি করছে, সংস্কার শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন। আবার কোনো কোনো দল বলছে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলেও সমস্যা নেই; সংস্কার শেষ করে জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া হোক। তবে এর জন্য সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দাবি করছেন তারা। তবে এনসিপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল বলছে, জুলাই সনদ, বিচার ও সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হোক। এ জন্য তারা কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপও জোরালোভাবে দাবি করছে না। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য বিএনপি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে।  বিএনপি জাতির বৃহত্তর স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবে।  বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে এই বিএনপি, সামরিক স্বৈরশাসনের অবসানে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। 

বিচার, সুষ্ঠু ভোটার তালিকা, জুলাই সনদ ও ঘোষণাসহ পাঁচটি ন্যূনতম সংস্কার করে নির্বাচন চান জানিয়ে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, প্রধান উপদেষ্টা একটি সময়সীমা দিয়েছেন, জামায়াতও মতামত দিয়েছে। আগামী রমজানের আগে নির্বাচন হতে পারে। কোনো কারণে যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। সময় বেঁধে দিতে চাই না।

এর আগে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গত সোমবার ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বলেন, জুলাই মাসে আমাদের গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি হবে। ৫ আগস্টের আগে জুলাই মাসের মধ্যেই যাতে সব দলের স্বাক্ষর নিয়ে জুলাই সনদটি কার্যকর করা হয়। জুলাই সনদ ঘোষণার আগে যদি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়, তাহলে সংস্কার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। জুলাই সনদ হওয়ার পরে আমরা জানাব যে, কোন সময় আমরা নির্বাচন চাচ্ছি। 

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, কিছু বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত হচ্ছে। এগুলো জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তি। এই ঐকমত্যের ভিত্তি জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদও ঘোষণা করা হবে। তবে কিছু বিষয়ে সবাই একমত হবে না এটাই স্বাভাবিক।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মোটাদাগে সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছে। নির্বাচনসংক্রান্ত সংস্কার নিয়ে ইতিমধ্যেই একটি সাধারণ ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় বলা আছে আগামী ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা। বিএনপিসহ আমরা বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছি। এটাও প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত রোডম্যাপের মধ্যে আছে। যেহেতু সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যেই তাদের প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, এখন চাইলে ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারের চ্যালেঞ্জ অনেক বেড়ে গেছে। কারণ মাঝখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে। এই দূরত্ব দূর করতে হলে নির্বাচন, প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত শেষ করতে হবে এবং বিচারকে দৃশ্যমান করতে হবে। দূরত্ব কমানো ছাড়া সরকার সফল হতে পারবে না, রাজনৈতিক দলগুলোও যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চাচ্ছে তা পারবে না। সুতরাং দুই পক্ষকে একে অপরের পরিপূরক সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।