দেশের রাজনীতির আকাশের কালো মেঘ কেটেছে হাজার মাইল দূরে লন্ডনে ড. ইউনুস-তারেক বৈঠকের মাধ্যমে। নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের ইঙ্গিতে শক্ত বরফ গলেছে এই বৈঠকে। এমনটিই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। বৈঠকটি সরকারের প্রতি বিএনপির আস্থা ফিরিয়ে আনতে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে বলে মত তাদের।
তারা বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়ে অন্য দলগুলোর ঐকমত্য দরকার। সে জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, যারা হতাশা প্রকাশ করছে, তাদের না আছে নিবন্ধন, না আছে জনসমর্থন। যে কারণে করছে হা-হুতাশ।
সংস্কার, বিচার ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিএনপির সম্পর্কে টানাপোড়েনের মধ্যেই গত শুক্রবার লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দুজনের মধ্যে আলোচনায় সংস্কার ও বিচার দৃশ্যমান করা গেলে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে নির্বাচন আয়োজনে সম্মতি দেন প্রধান উপদেষ্টা। এই খবরে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর মধ্যে ফেরে স্বস্তি। দূর হয়েছে সরকারের প্রতি অবিশ্বাস। আপাতত অবসান অদৃশ্য দ্বন্দের।
নির্বাচন বিশ্লেষক ড. মো. আব্দুল আলীম মনে করেন, সরকার ও বিএনপির মধ্যে এখন আর কোনো টানাপোড়েন নেই। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, সরকারের এখন উচিত হবে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে কীভাবে সবাইকে সন্তুষ্ট রেখে নির্বাচনের আয়োজন করা যায়। এটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। কীভাবে রমজানের আগে নির্বাচন করা যায়, তার জন্য কাজ শুরু করা।
সেটি কাটিয়ে ওঠা বড় মাইলফলক। জুলাই চার্টার্ড নিয়ে কিন্তু সমস্যা তৈরি হতে পারে। বিএনপি কি সব বিষয়ে একমত হবে? তাদের পছন্দ না হলে যদি সই না করে, তখন তো আরেকটা ঝামেলা তৈরি হবে। তাই সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে সরকারকে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকে দেশে গণতন্ত্রে উত্তরণের অনেকটাই নিরসন হয়েছে বলে মনে করেন আরেক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, আপাতত যেসব সমস্যা ছিল, সেই সংকট আর থাকেছে না। এটি বেশ স্বস্তির খবর। তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশে গণতন্ত্রে সমস্যা অব্যাহত, এমন সংকট চলমান থাকে। সামনেও দেখা দেবে এমনটি ধরেই এগিয়ে যেতে হবে। তবে যারা নেতৃত্বে থাকে তাদের দূরদৃষ্টি কিংবা বিচক্ষণতা সংকট সমাধানের পথ বের করে নিতে হয়।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, রমজানের আগে নির্বাচন হলে রাজনৈতিক সংকট কেটে যাবে। তার জন্য সরকারকে নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানান তারা। তবে ভোটের দিনক্ষণ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এনসিপি নেতারা। যদিও এখনো ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারলে সংকট বাড়বে, আর তাতে রাজনীতিতে সুবিধা নেবে পতিত স্বৈরাচার। বিএনপি নেতারা মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশের কালো মেঘ সরেছে লন্ডনে তারেক-ড. ইউনুস বৈঠকে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচন দ্রুত হলে সংকট কেটে যাবে। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। জনগণের ভোটে যারা ক্ষমতায় যাবে, তারা এগিয়ে নেবে সংস্কার। আর বিচার তো চলবেই। গত ১৫ বছর যারা মানুষ মেরেছে, গণহত্যা করেছে, তাদের বিচার না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানে যেভাবে গণহত্যা চালিয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ, তাদের বিচার না করার তো কোনো কারণ নেই। যারা নির্বাচিত হবেন, তারা শক্তিশালী হয়ে যাবেন ভোটে জয়ের কারণে।
তারা বিচারও করতে পারবেন, সংস্কারও করতে পারবেন। যারা উল্টাপাল্টা কথা বলে তাদের তো নিবন্ধন নেই। তারা তো কোনো দিন নির্বাচন করে দেখেনি। চ্যালেঞ্জগুলো তারা বোঝে না, জানে না। ভোটে দাঁড়াক, দেখি তারা কয়টা ভোট পায়। তাদের সম্ভবনা ছিল, কিন্তু তাদের ঔদ্ধত্য তাদের জনপ্রিয়তাকে নষ্ট করছে। তাদের জন্য দুঃখ হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এ বছরের শেষের দিকে তফসিল ঘোষণা বাঞ্ছনীয়। তফসিল থেকে ভোটের দিন অবধি ৪৫-৫০ দিন সময় লাগে। যারা হতাশা প্রকাশ করে তারা দুর্বল। যেহেতু লম্বা সময় পর নির্বাচন হবে, তাই নিরপক্ষে থাকতে হবে সরকারকে। অন্তর্বর্তী সরকার মূলত একপ্রকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই সরকারের প্রধান এবং একমাত্র কাজ হবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা। সরকারের নাম কী হবে, সেটা কোনো বিষয় না। কাজ হবে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের অয়োজন করা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ আছে। বিএনপিকে জনগণ যদি ভোট দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আনে, তাহলে অবশ্যই দেশের জন্য ড. ইউনূসকে কাজে লাগানো হবে। দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এ ব্যাপারে তার পরামর্শ নেওয়া হবে। এ রকম আরও যারা আছেন, তাদের মতামত নিয়ে কাজ করতে চান তারেক রহমান।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির রূপালী বাংলাদেশকে এসব কথা বলেন। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের সঙ্গে লন্ডনে তারেক রহমানের বৈঠকে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যে দূরত্ব ছিল, তা ঘুচে গেছে বলেই মনে করেন তিনি। লন্ডনের হোটেল ডোরচেস্টারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলেও মনে করেন তিনি।
জুলাই হত্যার বিচার ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি সব দলকে আস্থায় এনে জাতিকে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে বর্তমান সরকার সক্ষম হবে এমনটাই আশা বিশ্লেষকদের।