ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০২৫

নীরব পুলিশ, উদ্বেগ বাড়াচ্ছে মব সহিংসতা

শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৫, ০৫:৩৪ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মব সহিংসতা। প্রতিনিয়তই কোথাও না কোথাও গণপিটুনির নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও হামলার ঘটনা ঘটছে। এতে নিহত হচ্ছে দুষ্কৃতকারী ছাড়াও নিরপরাধ মানুষ। মব সহিংসতার শিকার হচ্ছে পুলিশ, শিক্ষক থেকে শুরু করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী ছাড়াও সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বাদ যাচ্ছেন না বিদেশিরাও। বাসা-বাড়িতে লোকজন ঢুকে সবকিছু তছনছ করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সন্ত্রাসী নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ‘তৌহিদি জনতা’।

পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও ঢিলেঢালা মনোভাবের সুযোগে একদল জনতা মব তৈরি করছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়াচ্ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ ছাড়া মবের সুযোগ নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে অন্যায় স্বার্থ হাসিল করছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও চাকরিচ্যুতিতেও মবের সুযোগ নিচ্ছে অসাধু চক্র। অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১১ মাসেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি মব সহিংসতা। 

সর্বশেষ গত রোববার সন্ধ্যায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে মব তৈরি করে হেনস্তার পর পুলিশে সোপর্দ করে একদল জনতা। এ সময় পুলিশ পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও মবকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ ঘটনার পর থেকে মব সন্ত্রাস আতঙ্কে রয়েছেন শেখ হাসিনা সরকারের রাজনীতিবিদ ও আমলারা। তবে মব সৃষ্টি করে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। 

সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর আক্রমণ ও তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা বেআইনি, আইনের শাসনের পরিপন্থি ও ফৌজদারি অপরাধ। মব সৃষ্টি করে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী সবাইকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

জানা গেছে, গত ১১ মাসে মব সহিংসতার নামে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১১ মাসে গণপিটুনিতে দেশে অন্তত ১৭৯ জন নিহত এবং আড়াই শতাধিক আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে ঢাকা বিভাগে। 

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন স্থানে ঘটা এ ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা প্রতিরোধে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ক্রমাগত হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের কারণে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম না হলে রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মব প্রতিরোধে কাজ করছে সরকার।’ 

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো- অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এ-সংক্রান্ত মামলায় শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছে আরেক অপরাধী চক্র।

তারা বলছেন, বেশকিছু কারণে মব সহিংসতা বাড়ছে। তার মধ্যে দীর্ঘদিনের অগণতান্ত্রিক পরিবেশ, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, প্রশাসনে অস্থিতিশীলতা ও ভীতি, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করা এবং সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার বা গুজবের কারণে এ জাতীয় সহিংসতা বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এহেন অপরাধে জড়িতদের কঠোর আইনগত ব্যবস্থার মুখোমুখি করতে হবে। মবের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স দরকার। নইলে মব ভায়োলেন্স কমবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১১ মাসে দেশের আট বিভাগে ১৭৯ জনকে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটির তথ্য বলছে, কোথাও চোর-ছিনতাইকারী-চাঁদাবাজ এবং কোথাও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সহযোগী ও দোসর অপবাদ দিয়ে মব সৃষ্টি করে এসব মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও ছিল না। 

আসকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২৩ জুন পর্যন্ত ১৭৯ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮৪ জন, চট্টগ্রামে ২৯ জন, খুলনায় ১৪ জন, রাজশাহীতে ১৬ জন, রংপুরে ৮ জন, সিলেটে ৫ জন, বরিশাল বিভাগে ১৭ জন ও ময়মনসিংহে ৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ থেকে চলতি মাসের গতকাল পর্যন্ত সাড়ে ৫ বছরে দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ৩৬১ জন। সর্বোচ্চ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে গত বছর। ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ১২৮ জন। যা আগের বছরের প্রায় তিনগুণ। ২০২৩ সালে নিহত হয়েছে ৫১ জন।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৮ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে মব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১৯৯টি। এর মধ্যে আহত হয়েছে ২০০ জন এবং নিহত হয়েছে ৯৩ জন। সংস্থাটির গত মে মাসের মব সহিংসতার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ মাসে অন্তত ৩৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৭ জন নিহত ও ৩৮ জন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে।

গণপিটুনির শিকার ৩০ জনকে আহতাবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। গণপিটুনিতে নিহতের মধ্যে ২ জন ডাকাতির অভিযোগে, ১ জন ছিনতাইকারী সন্দেহে, ৪ জন সন্দেজনক চুরির অভিযোগে, ১ জনকে চুরির অভিযোগে হত্যা করা হয়। অপরদিকে হত্যার অভিযোগে ২ জন, ৩ জন ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে, ৩ জন যৌন হয়রানির অভিযোগে, ৪ জন ছিনতাইয়ের অভিযোগে, ৯ জনকে নিষিদ্ধ লীগের নেতাকর্মী হওয়ার অভিযোগে, ৫ জন ডাকাতির অভিযোগে এবং সন্দেহজনক চুরি, চাঁদাবাজি, অপহরণ এ ধরনের অপরাধজনিত কারণে ১২ জনকে গণপিটুনি দিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। 

গত রোববার সন্ধ্যায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে মব তৈরি করে হেনস্তার পর পুলিশে সোপর্দ করে একদল জনতা। এদিন হুদার উত্তরার বাসায় ঢুকে একদল লোক তাকে বের করে আনে এবং জুতার মালা পরিয়ে দেয়। ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা যায়, নূরুল হুদা সাদা একটি টি-শার্ট ও লুঙ্গি পরা। তাকে ঘিরে রয়েছে একদল লোক। তারা নূরুল হুদাকে একটি জুতার মালা পরিয়ে রেখেছে। এক ব্যক্তিকে জুতা দিয়ে তাকে আঘাত করতেও দেখা যায়। কেউ কেউ নূরুল হুদার দিকে ডিম ছুড়ে মারতে দেখা যায়। তবে এ সময় পাশেই পুলিশ দাঁড়ানো ছিল। 

গত ২১ জুন শনিবার ঢাকা আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা হাইওয়ে সড়কের পাশে ফুটপাতে চাঁদা তোলার সময় ঢাকা জেলা তাঁতিদলের সভাপতি মো. জাকির হোসেন ওরফে ছোচা জাকিরকে গণপিটুনি দেয় স্থানীয় হকার ও এলাকাবাসী। একই দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর রামপুরা উলন রোডে আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের তৃতীয় স্ত্রী রিয়া মনি এবং বার ড্যান্সার ম্যাক্স অভি রিয়াজকে আপত্তিকর অবস্থায় হাতেনাতে ধরে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে এলাকাবাসী। একই দিন সকালে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় প্রবাসী হাবিবউল্লাহ হত্যায় জড়িত অভিযোগে হেলাল উদ্দিনকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। 

গত ৯ জুন রাতে লক্ষ্মীপুরের রামগতির চরগোড়াগাছা ইউনিয়নের পূর্ব চরকলাকোপা গ্রামে চোর সন্দেহে ৫০ বছর বয়সি মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত ১০ জুন রাতে খুলনার পাইকগাছায় রাতের অন্ধকারে হাতুড়িপেটা করে এক ইলেকট্রনিকস ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা ও দুটি মোবাইল ফোন ছিনতাই করে তিন দুর্বৃত্ত। এ সময় স্থানীয়রা ধাওয়া করে তুহিন দাশ নামে একজনকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।

গত ১২ জুন রাজধানীর মিরপুরে বাজার করতে গিয়ে মাসুদুর রহমান নামের একজন পুলিশ পরিদর্শক ‘মবের’ শিকার হয়েছেন। এ সময় তাকে মারধর করে নগদ টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে মিরপুর থানার পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। 

গত ৪ জুন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে কোরবান আলী নামের এক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্যকে পকেট মারার অভিযোগে গণপিটুনি দেয় স্থানীয় জনতা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ২৪-এর অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে নানা ইস্যু নিয়ে মব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং চলমান। এসব ঘটনা আইনের সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল। তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে বিশেষ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে সহিংসতা করতে চাইলে সরকারকে শক্ত হাতে তা দমন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের যেসব স্টেকহোল্ডার রয়েছেন, তাদের শক্ত অবস্থানে দেখা যাচ্ছে না। সরকারের দায়িত্বশীলরা দীর্ঘ সময়ের দোহাই দিয়ে এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয় চিন্তা করে শক্ত অবস্থানে নেই। যার ফলে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।

মব সহিংসতার নামে গণপিটুনির মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মো. সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, প্রথমত, এটি ঘটছে পরিকল্পিত উসকানির কারণে। সরকারের সহযোগী বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় কিছু ব্যক্তি এতে ইন্ধন জোগাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা একটা বড় কারণ। হয়তো ইচ্ছা করেই এ বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। সর্বোপরি সরকারের উদাসীনতা ও কোনো পদক্ষেপ নিতে অনীহার কারণেই বেড়ে যাচ্ছে গণপিটুনির প্রবণতা।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেছেন, মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো ধরনের অপরাধীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রপার অ্যাকশন নেবে। তিনি বলেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে আটকের সময় যেভাবে মব জাস্টিজ করা হয়েছে, তা কাম্য নয়। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর পুনরায় না ঘটে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হুদার ঘটনায় বাহিনীর কেউ দায়ী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।