‘আমি যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই তখন ৪০ হাজার টাকা দিয়ে বন্ধুরা মিলে একটি কঙ্কাল কিনেছিলাম। আমাদের খুব আগ্রহ ছিল যে, সত্যিকারের একজন চিকিৎসক হবো। তবে সেই কঙ্কালটি কিনে বেশ বিপদের মুখে পড়েছিলাম। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা আমাদের পেছনে লেগে যায়। পরে যে ডোমের কাছ থেকে কঙ্কাল সংগ্রহ করেছিলাম তার নামটা গোয়েন্দাকে বলেছিলাম। এর বেশ কিছুদিন পর ওই ডোমের চাকরি চলে যায়। তাকে পুলিশ আটক করে। এরপর থেকে আর কখনোই কঙ্কাল কেনার সাহস পাইনি’ কথাগুলো বলছিলেন ঢামেকের এক চিকিৎসক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চিকিৎসক বলেন, মেডিকেলের ছাত্রদের শিক্ষার ক্ষেত্রে কঙ্কাল সরবরাহ করার একটি নীতিমালা সরকারিভাবে রাখা উচিত। বাইরের দেশে এ বিষয়ে একটি আইন আছে, কিন্তু আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।
পিজি হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন, এমন এক চিকিৎসক রূপালী বাংলাদেশকে জানান, মেডিকেলে পড়ার সময় প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে কঙ্কালের প্রয়োজন হয়। কলেজের সিনিয়র এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে একটি কঙ্কাল কিনেছি। কিন্তু বর্তমানে বেওয়ারিশ লাশ গোপনে বিক্রি হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা বা তার বেশিতে। সেটাও আবার বৈধভাবে নয়। কৃত্রিম কঙ্কাল দিয়ে শিক্ষার বিষয়টি সঠিকভাবে হয় না। এজন্য অনেক শিক্ষার্থী গোপনে বেওয়ারিশ লাশের সন্ধান করেন বা লাশ ঘরের ডোমদের সাহায্য নিয়ে কঙ্কাল সংগ্রহ করে মেডিকেলে পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটায়।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) অ্যানাটমি বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. সামিনা জানান, মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণার জন্য দুভাবে কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের জন্য অনেকে দেহ দান করেন। এর বাইরে শিক্ষার্থীরা কঙ্কাল কিনে থাকেন নানা কৌশলে। তা ছাড়া মানুষের কঙ্কালের পরিবর্তে এখন কৃত্রিম কঙ্কালও ব্যবহার করা হয়। তবে কৃত্রিম কঙ্কাল দিয়ে শিক্ষার বিষয়টি সঠিকভাবে হয় না।
অভিযোগ রয়েছে, ঢামেকে লাশ বিক্রির সঙ্গে জড়িত ডোমদের প্রধান হিসেবে কাজ করছে একজন। যার রয়েছে ৮ জনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যারা সরাসরি লাশ বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত।
অভিভাবকহীন বেওয়ারিশ লাশ কি বিক্রি হচ্ছে: যেসব লাশ এক সপ্তাহ থেকে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো স্বজনের সন্ধান পাওয়া যায় না বা কেউ দাবি করে না, সেটিই বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে গণ্য হয়। এমন লাশগুলো কি বিক্রি হয়? প্রশ্নের উত্তরে যা জবাব পওয়া যায় তা অনেকটা হ্যাঁ সূচক। বেওয়ারিশ লাশ কারবারিরা ডোমদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে লাশটিকে নিজের স্বজনের বলে পরিচয় দেন। অনেক ক্ষেত্রে এ লাশ চুরি করানোও হয়, তারপর তা মেডিসিন ব্যবহার করে পচিয়ে কঙ্কাল বানিয়ে বিক্রি করে একটি চক্র।
পুলিশের তথ্য মতে, ভিখারি, ভবঘুরে থেকে মজদুর শ্রেণির মানুষ, যারা পরিচয়হীন, আশ্রয়হীন, ঠিকানাহীনভাবে বসবাস করে। যাদের মধ্যে থাকতে পারে রিকশাচালাক, হকার বা মজদুর। সাধারণত এই শ্রেণির মানুষেরা মারা গেলে অনেকক্ষেত্রে পরিচয়ের অভাবে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করার দায়িত্ব আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়ে। পরে আজিমপুর অথবা জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রতি বছরই বাড়ছে বেওয়ারিশ মরদেহের সংখ্যা।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের তথ্যমতে, ২০২২ সালে বেওয়ারিশ মরদেহ ছিল ৪৪৩টি। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯০। আর এ বছর প্রথম ৩ মাসেই বেওয়ারিশ মরদেহ মিলেছে ১২৬ জনের বেশি। ২০২৪ সালে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ৫৭০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। ২০২৫ সালের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি; তবে একটি সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের গত ৬ মাসে প্রায় তিন শতাধিক লাশের তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রশ্ন হলো বেওয়ারিশ লাশ সব কি দাফন হচ্ছে? যদি তা না হয় তবে কি বিক্রি হচ্ছে সে সব লাশ? কীভাবে বিক্রি হয় ও কারা জড়িত? অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের মর্গ থেকে বেওয়ারিশ লাশ বিক্রির সঙ্গে জড়িত একাধিক চক্র। তবে লাশগুলো বেশির ভাগই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থীদের কাছে কঙ্কাল হিসেবে মোটা দামে বিক্রি করে দেয় চক্রটি। মেডিকেল কলেজ ও কবরস্থানকেন্দ্রিক চক্রগুলোর সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেলের অসাধু কিছু চিকিৎসক ও শিক্ষার্থী।
নাম না প্রকাশের শর্তে, ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের সাবেক এক চিকিৎসক বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে নানা অবৈধ পন্থায় বেওয়ারিশ লাশ ও কঙ্কাল বিক্রি করা হয়। যার প্রধান ক্রেতা হচ্ছে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। বেশির ভাগ লাশ বিক্রির সঙ্গে জড়িত মর্গের নিয়োগপ্রাপ্ত ও চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীরা।
এ বিষয়ে আঞ্জুমান মুফিদুলের লাশ দাফনকারী কর্মকর্তা মো. কামরুল রূপালী বাংলাদেশকে জানান, আমরা লাশ ঠিকঠাকভাবে দাফন করি। পরে কি হয় জানি না। তা ছাড়া আমি এখন ঘুমিয়ে পড়ব, এসব বিষয়ে পরে কথা হবে।
লাশগুলো দাফন করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে তদারকি নেই: সাধারণত, বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধারের পর থানায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু বা আন-ন্যাচারাল ডেথ (ইউডি) মামলা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ দাফনের জন্য দিয়ে দেওয়া হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে। প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্বের সঙ্গে লাশের আনুষ্ঠানিক সব ধরনের কাজ সম্পন্ন করে আজিমপুর বা জুরাইন কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করতে পাঠায়। কিন্তু এরপর লাশগুলো দাফন করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে কেউ তদারকি করে না, যে সুযোগটি গ্রহণ করে এই চক্রটি।
বাংলাদেশে বেওয়ারিশ লাশের (অশনাক্তকৃত মৃতদেহ) ক্ষেত্রে আইন রয়েছে, যা মৃতদেহ শনাক্তকরণ, ময়নাতদন্ত এবং দাফন বা সৎকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে। যদি কোনো মৃতদেহ শনাক্ত করা না যায়, তবে পুলিশ তার পরিচয় জানার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়, যেমন আঙুলের ছাপ সংগ্রহ ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো। এরপর, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মতো সেবামূলক সংস্থা লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোও এ বিষয়ে দায়িত্ব পালন করে।
ডোমরাও ঝুঁকেছেন লাশ বিক্রিতে:
টাকা ছাড়া চলা যায় না। সবাই চায় টাকা আয় করতে। এই টাকার জন্য ডোমরাও ঝুঁকেছেন লাশ বিক্রিতে। লাশ নিজেদের জিম্মায় এনে সুযোগ বুঝে তা বিক্রি করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে ফরেনসিক বিভাগে ২৪ বছর দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ঢামেকের সাবেক অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বেওয়ারিশ লাশ সরকারি হাসপাতাল থেকে নিয়ে সংরক্ষণের কোনো বিধান নেই। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেওয়ারিশ লাশ এবং হাড়গোড়ের অবৈধ ব্যবসার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে লাশ কাটা ঘরের কর্মচারীদের নিয়ে। কর্মচারী বিভিন্ন কৌশলে এসব লাশ বিক্রি করে থাকেন। যা অনেকেই বোঝেন না। তিনি জানান, যতটুকু জানতে পেরেছি এ চক্রটি একটি লাশ ২ থেকে ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করে থাকে। তারা যেহেতু লাশ নিয়ে খেলা করে এজন্য এই মোটা অঙ্কের টাকা রোজগারের লোভ সামলাতে না পেরে এসব কাজে যুক্ত হচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এক মহাপরিচালক জানান, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন ডোমের কাছ থেকে একটি লাশ কিনে ছিলাম। যদিও এটা অপরাধ হলেও আমাদের আমাদের মেডিকেলের জন্য অনেকটা ভালো।
তিনি বলেন, কঙ্কালের অনেক দাম থাকায় ছাত্রজীবনে অনেকেই কিনতে পারেন না। এ ছাড়া কৃত্রিম যে কঙ্কাল পাওয়া যায় তারও দাম অনেক বেশি। এ ছাড়া কৃত্রিম কঙ্কাল দিয়ে শিক্ষা সঠিকভাবে না হওয়ায় আসল কঙ্কালের প্রতি চাহিদা বাড়ছে।
কঙ্কাল ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই
দেশে মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণার জন্য কঙ্কালের ব্যবহার থাকলেও এটি সরবরাহে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এখনো হয়নি। ফলে অবৈধ নানা পন্থায় কঙ্কাল কেনা হয় বলে মনে করছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তরের এক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জানান, পরিচয়হীন কোনো লাশ কোর্ট বেওয়ারিশ ঘোষণার পরই কেবল তা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কঙ্কাল তৈরি করা হয়। এসব কঙ্কাল সরকারি মেডিকেলের অ্যানাটমি বিভাগের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হয়।
সাবেক এই মহাপরিচালক জানান, মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণায় কঙ্কালের ব্যবহার থাকলেও তা সরবরাহে নেই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। ফলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা সবসময়ই কঙ্কালসংকটে ভোগেন। তিনি জানান, সরকারি মেডিকেল কলেজ বিভিন্ন সময় একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে নতুন একটি আইন পাস করা খুবই কঠিন। ফলে তা আলোর মুখ দেখেনি।
আপনার মতামত লিখুন :