রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে গত সোমবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনের ওপর হঠাৎ আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হয় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা পুরো জাতিকে শোকে বিহ্বল করে তুলেছে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, স্কুল কর্তৃপক্ষ সবাই শোকাহত ও মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন। আদরের শিশুসন্তান ও প্রিয় শিক্ষার্থীদের নির্মম মৃত্যুতে দিশাহারা অভিভাবক ও শিক্ষকরা। তবে ভয়ঙ্কর এই ট্র্যাজেডির দুই দিন পার হলেও এখনো অনেক অভিভাবক তার আদরের সন্তানের খোঁজ পায়নি। কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ‘আমাদের সন্তান জীবিত না মৃত, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। অন্তত লাশটা পেলেও মনকে সান্ত¡না দেওয়া যেত’।
জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইসা মনির। তার পরিবার বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাস্থল ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে হাসপাতালে রাইসা মনিরকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে গতকাল জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে রাইসার খোঁজে আসেন তার চাচা এমদাদুল হক। এ সময় এমদাদুল হক বলেন, রাইসা জীবিত না মৃত সেটা বুঝতে পারছি না। এ সময় মোবাইল ফোনে থাকা রাইসার ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘রাইসা মাইলস্টোন স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। কাল রাইসা স্কুলে গেছে। বিমান দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমাদের পরিবার স্কুলে যায়, কিন্তু ওকে পাওয়া যায়নি’।
এমদাদুল আরও বলেন, ‘স্কুলে না পেয়ে আমরা তাকে বিভিন্ন হাসপাতালে খুঁজতে থাকি। কিন্তু কোথাও খোঁজ পাচ্ছি না। একদিন হয়ে গেলেও মেয়েটাকে কোথাও পেলাম না। পরিবার মেয়ের জন্য পাগল হয়ে আছে। মেয়েটা আছে নাকি চিরতরে হারিয়ে গেছে কিছুই বুঝতেছি না। ওর কিছু হলে আমাদের পরিবার কি নিয়ে বাঁচবে’।
শুধু রাইসা মনি নয়, মাইলস্টোন কলেজের এমন ৮ থেকে ১০ জন শিক্ষার্থী এখনো নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি পরিবারের সদস্যদের। তারা বলছেনÑ এখনো তাদের সন্তানদের খোঁজ মেলেনি। আবির নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, আমার ভাগনে স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ক্লাস শেষে তারা বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিলামÑ এমন সময় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। পরে আর তাকে পাওয়া যায়নি। ফেরদৌসী বেগম নামের আরেক অভিভাবক জানান, তার মেয়েকেও এখনো খুঁজে পাননি।
এদিকে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী নিহতদের সবাই শিশু বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান। তিনি জানান, যারা মারা গেছে তারা সবাই বেশির ভাগ শিশু। এর মধ্যে ৭ জনের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষা লাগবে। ডিএনএ’র পর তাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
মূহূর্তেই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আগুনে ঝলসে গেছে: নিজ ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় চোখের সামনে কীভাবে বেস্ট ফ্রেন্ডকে হারিয়েছেন সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. ফারহান হাসান বলেন, ‘ঘটনার দিন আমার একটি পরীক্ষা ছিল। বেলা ১টায় পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। এমন সময় হঠাৎ করেই বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি আমাদের সামনে আছড়ে পড়ে। ঠিক এ সময় আমার একটা বেস্ট ফ্রেন্ড, যে পরীক্ষার হলে আমার সাথে একসঙ্গে ছিল। তাকিয়ে দেখি আমার চোখের সামনেই আগুনে পুড়ে মারা গেল। আমি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম। চারদিকে মানুষের আর্তনাদ-হাহাকার। কে কাকে বাঁচাবে। সবাই বাঁচতে চায়। কেউ কেউ গায়ে আগুন লাগা অবস্থায় নিজেকে বাঁচাতে দৌঁড়াতে থাকে আর আর্তনাদ করতে থাকে’।
ফারহান আরও বলেন, ‘বিধ্বস্ত হওয়ার সময় দেখা যায় বিমানটি স্কুলের একটি ভবনে আঘাত করে। ঘটনাটি ঘটে স্কুল ছুটির ঠিক আগ মুহূর্তেই।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘স্কুল ছুটি হবে হবেÑ এমন সময় বিমানটা সরাসরি জুনিয়র সেকশনের বিল্ডিংয়ে আঘাত করে, যেখানে নার্সারি, ওয়ান, টু, থ্রিÑ এসব শ্রেণির ক্লাস হয়। বিল্ডিংয়ের গেটে একেবারে গর্ত হয়ে আগুন ধরে যায়’।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে রূপ নেয়: ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কান্না করেন ফাতেমা খাতুন। মা ফাতেমা খানের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়েছিলেন ইয়ানা খান। কিন্তু আনন্দের মুহূর্ত নিমিষেই রূপ নেয় বিষাদে। চোখের সামনে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয় স্কুলের ভবনে। এ সময় মাঠের কোণায় থাকায় তারাও দগ্ধ হন। পরে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাদের। চিকিৎসা শেষে ফেরার পথে বীভৎস দৃশ্যের বর্ণনা করেন ফাতেমা। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতেই পারিনি কী হলো। হঠাৎ দেখি আগুনের কু-লি আর বিকট শব্দ। একপর্যায়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। এরপরই চোখের সামনে ছোট বাচ্চাদের শরীর ঝলসে ঝলসে পড়ছে। কেউ কেউ আবার নিথর হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। বাচ্চারা মাটিতে লুটে ছিল কে কাকে ধরবে কে বা কাকে বাঁচাবে?
তিনি আরও বলেন, ‘মুহূর্তেই চারদিকে কান্নার রোল পড়ে গেল। আতঙ্কে সবাই ছোটাছুটি করতে থাকে। কিন্তু আগুনের তাপের কারণে কেউ সামনে যেতে পারছে না। এ আগুনের রং যেন বিভীষিকাময় অন্ধকার। একটা শিশুর দেহ দুই টুকরো হয়ে গেল, আমি সহ্য করতে পারলাম না। সেখানেই জ্ঞান হারালাম।’
দগ্ধরা বাঁচতে কান্নাকাটি করলেও কাউকে পাশে পায়নি: ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সাব্বির জানান, ঘটনার সময় ৫ নম্বর ভবনে ক্লাস ছিল। বেলা ১টায় ক্লাস শেষ হলে সবাই যখন বের হচ্ছিল, ঠিক তখনই বিমানটি আছড়ে পড়ে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আগুনের লেলিহান শিখা। প্রচ- কালো ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা ছোটাছুটি করতে থাকে। দগ্ধ অনেকে বাঁচার জন্য কান্নাকাটি করতে থাকে।
ছাত্রী জাফরিন রহমান জানান, যেখানে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে, সেখানে জুনিয়র শিক্ষার্থীরা ছিল। ক্লাস ওয়ান থেকে থ্রি পর্যন্ত ক্লাস হয় ভবনটিতে। তবে যারা কোচিং-এর ক্লাস করে, তারাই কক্ষটিতে ছিল। প্রচ- কালো ধোঁয়ার কারণে কিছু চোখে দেখা যাচ্ছিল না। চারদিক অন্ধকার, তা ছাড়া দগ্ধরা বাঁচতে কান্নাকাটি করলেও আগুনের তাপের কারণে তারা কাউকে পাশে পায়নি।
মাইলস্টোনের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সায়েম বলেন, ক্লাসে বসেই বেলা ১টা ১১ মিনিটের দিকে বিকট শব্দ শুনতে পাই। পরে কিছু সময় কানে দম লাগে। এ সময় পাশের চার নম্বর ভবনের শ্রেণিকক্ষে ছিলাম। দৌড়ে এসে দেখি আগুন জ্বলছে হায়দার আলী ভবনে। তারা এক্সটিংগুইশার নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আগুনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে তারা কাছে যেতে পারছিলেন না। কিছু শিক্ষার্থীর শরীর তখনো জ্বলছিল। ওই অবস্থায়ই অনেক শিক্ষার্থীকে বের হয়ে আসতে দেখা যায়। কিছু অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসরুমে আটকা পড়ে থাকে।
শিক্ষার্থী চয়ন বলেন, হায়দার আলী ভবনের প্রধান ফটকের ভেতর বিমানের একটি অংশ ঢুকে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের অনেকের পক্ষেই বের হওয়া সম্ভব হয়নি। কেননা চারপাশে লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো ছিল। তাই নিচে যারা ছিল, তারা আর বের হতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিস আসার পর আগুন নেভানোর পর গ্রিল কেটে এবং ছাদে মই দিয়ে উঠে ছাদ কেটে তাদের উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী আরেক শিক্ষার্থী বলেন, স্কুল ১টার মধ্যে ছুটি হয়ে যায়। কিছু শিক্ষার্থী বেরও হয়েছিল আর কিছু বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। অনেকে আবার স্যারদের কাছে কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। কোচিংও অনেকের জীবনে কাল হলো।
আপনার মতামত লিখুন :