দাবি আদায়ে সচিবালয় এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটাও করা হয়। এ ঘটনায় শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও পুলিশসহ শতাধিক আহত হয়েছেন। তাদের অনেককে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষের সময় সচিবালয়ের ভেতরে বেশকিছু গাড়ি ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেছেন শিক্ষার্থীরা।
গতকাল বিমান দুর্ঘটনায় নিহত-আহত শিক্ষার্থীদের সঠিক তথ্য প্রকাশে এবং শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করছিলেন শিক্ষার্থীরা। এই কর্মসূচিতে অংশ নেয় ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, নূর মোহাম্মদ কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ, কমার্স কলেজ, আদমজি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, মিরপুর কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের চলমান এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ আরও কিছু শিক্ষার্থী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের সচিবালয়ের ভেতর থেকে বের করতে পারলেও আশপাশের এলাকায় কয়েক ঘণ্টা ধরে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং সংঘর্ষ চলে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ফটক খুলে সচিবালয়ের ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় তারা সচিবালয়ের ভেতর পার্কিংয়ে থাকা বেশ কয়েকটি গাড়ি ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বিকেল ৪টা ১০ মিনিটের দিকে তাদের ওপর চড়াও হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শিক্ষার্থীদের সচিবালয় থেকে বের করে দেন। এরপর সচিবালয়ের সামনে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
এর আগে বেলা আড়াইটার দিকে শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষাসচিবের পদত্যাগ দাবিতে সচিবালয়ের প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা আড়াইটার দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের এক নম্বর গেটের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁরা ‘ভুয়া ভুয়া’, ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব দে’ ও ‘সব লাশ ফেরত দে’Ñ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
বিক্ষোভের শুরুতে শিক্ষার্থীরা প্রথমে সচিবালয়ের তিন নম্বর ফটকের সামনে বিক্ষোভ করছিলেন। পরে প্রশাসনের এই প্রাণকেন্দ্রের বাকি ফটকগুলোও তারা বন্ধ করে দেন। অন্যদিকে নিরাপত্তার স্বার্থে ভেতর থেকেও কয়েকটি ফটক বন্ধ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে সচিবালয়ের ভেতরে যারা ছিলেন তারা আটকা পড়েন। অন্যদিকে বাইরে থেকে কেউ ভেতরে ঢুকতেও পারছিলেন না।
বিক্ষোভের একপর্যায়ে একটি গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়তে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। তাদের সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে পুলিশও ঢুকে পড়ে। পরে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে তাদের উপরে চড়াও হয় পুলিশ। কিছু সময় পর সচিবালয়ের সামনের এলাকা অনেকটা ফাঁকা দেখা যায়। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে শিক্ষার্থীরা জিরো পয়েন্টের দিকে অবস্থান নেন। এ সময় জিরো পয়েন্টের দিকে পুলিশ কয়েক দফা সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
সংঘর্ষে প্রায় শতাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহতদের মধ্যে ৮০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সচিবালয়ের সামনের আব্দুল গনি রোডে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। এর আগে শিক্ষার্থীরা দুপুরে প্রথমে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করতে যায়। সেখান থেকে বেলা দেড়টার দিকে সচিবালয়ের সামনে আসে তারা।
জানা গেছে, দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনার পরও এদিনের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা আসে গভীর রাতে। এতে অনেক শিক্ষার্থীর কাছে সেই খবর পৌঁছাতে পারেনি। অনেকে এদিন কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পৌঁছেও যান সময়মতো।
ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী জোনায়েদ আহমেদ সচিবালয়ের দিকে যাওয়ার সময় শিক্ষা ভবনের সামনে বলেন, মাইলস্টোন কলেজে এত বড় বিপর্যয়ের পরও আজকের (গতকাল) এইচএসসি পরীক্ষা প্রথমে স্থগিত করা হয়নি। রাত ৩টার দিকে কেন এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে? সকালে ঘুম থেকে উঠে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার পর শুনলাম পরীক্ষা স্থগিত। এমন অবিবেচক শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবকে আর দেখতে চাই না। তাই তাদের পদত্যাগের দাবিতে সচিবালয়ের সামনে এসেছি।
এ ছাড়া আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের ফটকে এসেছে। যারা এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের খাতা পুনর্মূল্যায়নের দাবিতে সচিবালয়ের সামনে এসেছে শিক্ষার্থীরা।
সিটি কলেজের শিক্ষার্থী তানভীর বলেন, গোপালগঞ্জে সামান্য কারণে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করেছে। অথচ কালকে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, বারবার বলার পরও তারা এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করেনি। রাত ৩টার সময় যখন স্থগিত করা হয়, সব শিক্ষার্থীরা জানতেও পারেনি। সকালবেলা অনেকে পরীক্ষা দিতে বেরিয়েছে। এগুলো স্পষ্টভাবে দায়িত্বে অবহেলা। আমরা এই শিক্ষা সচিব ও শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ চাই। তাদের পদত্যাগ নিশ্চিত না করে ঘরে ফিরে যাব না।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান আরেফিন বলেন, প্রশ্নপত্রে ভুল, দায়িত্বে অবহেলাসহ বিভিন্ন কারণে আমরা শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবের পদত্যাগ চাইছি। মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে বলেও দাবি আরেফিনের।
গতকাল এইচএসসিতে রসায়ন (তত্ত্বীয়) দ্বিতীয় পত্র, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি দ্বিতীয় পত্র (মানবিক শাখা), ইতিহাস দ্বিতীয় পত্র বা গৃহ ব্যবস্থাপনা ও পারিবারিক জীবন দ্বিতীয় পত্র এবং উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল।
বন্যা পরিস্থিতির কারণে এর আগে গত ১০ জুলাই কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এবং বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। আর সংঘাতের পর কারফিউ জারির কারণে ১৭ জুলাই গোপালগঞ্জ জেলার ঢাকা, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের আওতাধীন সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছিল।
অপরদিকে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে হতাহতের ঘটনায় গতকাল এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করার ঘোষণা আসে গত সোমবার গভীর রাতে। তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ফেসবুক পেজে এক অ্যাডমিন পোস্টে বলা হয়, ‘শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়ের সাথে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সাক্ষাৎ হয়েছে। আজকের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা’।
এদিকে বিমান দুর্ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনার সঠিক তথ্য প্রকাশ এবং গভীর রাতে চলমান এইচএসসি পরীক্ষার সময়সূচি পরিবর্তনের প্রতিবাদে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এর ফলে মহাসড়কের দুই পাশে অসংখ্য যান আটকে যায়। এতে সড়কের দুই পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় এবং দূর-দূরান্ত থেকে আসা যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
একই দাবিতে সিলেটে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিকেলে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে এসে তারা সিলেট শিক্ষা বোর্ডের সামনে জড়ো হন এবং শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দেন। দুপুর থেকেই সিলেট শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শিক্ষার্থীরা সিলেট শিক্ষা বোর্ড কার্যালয়ের সামনে এসে অবস্থান নেন। প্রথমে তারা শান্তিপূর্ণভাবে স্লোগান দিলেও, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে বিকেল ৪টার দিকে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক অবরোধ করেন। এতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে।
আপনার মতামত লিখুন :