বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২৫, ১২:৩২ এএম

অসাধু চক্রের মানবকঙ্কাল পাচারের রমরমা ব্যবসা

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২৫, ১২:৩২ এএম

অসাধু চক্রের মানবকঙ্কাল পাচারের রমরমা ব্যবসা

মৃত মানুষের কঙ্কাল চুরি করে বিদেশে পাচার করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। যে চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে মেডিকেল কলেজের কিছু শিক্ষার্থী, মর্গের ডোম, বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের কয়েকজন অসাধু মালিক আর সীমান্তের কিছু চোরাকারবারি। গোয়েন্দা সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মৃত মানুষের কঙ্কাল চুরি করে বিদেশে পাচার করছে সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র। কবরস্থান থেকে মরদেহ চুরি করার পর হাতবদল হচ্ছে মানুষের কঙ্কাল।

বিভিন্ন সময়ে পুলিশের নানা অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে চক্রের সক্রিয় সদস্যদের, তবুও থামছে না এ কারবার। পুলিশ বলছে, চক্রগুলো কঙ্কাল চুরির আগে নির্দিষ্ট স্থান রেকি করে নেয়। এ ছাড়া কঙ্কাল চোর চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে মাদকাসক্তরাও। সাধারণত এদের এসব অপকর্মে ব্যবহার করা হয়।

চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ভোলায় রাতের আঁধারে পাঁচটি কবর খুঁড়ে দুই নারীর লাশ চুরির ঘটনা ঘটে। জেলার দৌলতখান উপজেলার উত্তর জয়নগর ইউনিয়নের মধ্যজয়নগর গ্রামের কামাল পাটোয়ারীবাড়ি জামে মসজিদের পাশে মকবুল হাজীবাড়ি ও মীরাবাড়ির যৌথ কবরস্থান থেকে লাশগুলো চুরি করা হয়। স্থানীয়রা জানান, মকবুল হাজীবাড়ি ও মীরাবাড়ির যৌথ পারিবারিক কবরস্থানে প্রায় ৫০টির বেশি কবর রয়েছে। সেখান থেকে রাতে পাঁচটি কবর খুুঁড়ে বিবি হাজেরা ও শাহানাজের লাশ চুরি করা হয়। তারা এক বছর আগে মারা গেলে ওই কবরস্থানে দাফন করা হয়। স্থানীয় মিজানুর রহমান জানান, কামাল পাটোয়ারীবাড়ি জামে মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় শেষে তিনি ওই কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পাঁচটি কবর খোঁড়া দেখতে পান। পরে বিষয়টি এলাকাবাসীকে জানালে তারা এসে দেখেনÑ পাঁচটি কবর থেকে বিবি হাজেরা ও শাহানাজের লাশ চুরি করে নিয়ে যায় চোরচক্র। এর আগে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বেজগাঁও কবরস্থান থেকে কয়েকটি লাশ চুরি হয়। 

এ ছাড়া চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় একটি কবরস্থান থেকে তিনটি লাশ চুরির ঘটনা ঘটে। পরদিন ভোরে মুসল্লিরা পশ্চিম চিত্রাপাড়া কবরস্থানে ছয়টি কবর খোঁড়া অবস্থায় দেখতে পান। এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়রা এসে দেখেনÑ চিত্রাপাড়া গ্রামের লিয়াকত আলী, চাঁদ মিয়া ও বায়জিদ হোসেনের কবরে লাশ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এই তিনটি লাশ চুরি হয়েছে।

একই মাসের ২৪ তারিখ কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে কবর খুঁড়ে দুইটি লাশের কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, রাতের কোনো একসময় উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের নুরপুর পাহাড়পুর কবরস্থানে এ ঘটনা ঘটে। নগর সাঁওতা পশ্চিম পাড়ার আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী মৃত সারা খাতুন (৮৫) ও মনিরুজ্জামানের ছেলে রাতুল (১৪) সম্পর্কে তারা দাদি ও নাতি।

এদিকে ২০২৪ সালে শেরপুরে কবর থেকে লাশ চুরির ঘটনা এতটাই উদ্বেগের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, স্বজনরা প্রিয়জনের শেষ স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে কবর পাকা করে সেখানে লোহার গ্রিল লাগানোর ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় চলতে থাকে রাত জেগে পাহারা। পুলিশ জানিয়েছে, গত ১২ মাসে শেরপুর থেকে শতাধিক কঙ্কাল চুরি যায়। আসামিদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ‘কঙ্কাল চুরির আগে রেকি করে চোরচক্র। রাত ১২টা থেকে ৩টার মধ্যে কঙ্কাল চুরি করা হয়। সাধারণত এক বছরের পুরোনো কবরগুলো থেকে কঙ্কাল বের করে আনা হয়। কারণ এক বছরের আগের কঙ্কালে মাংস থাকে। একেকটি কঙ্কাল রাসায়নিক দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে ৪০-৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে চোরচক্র।’

কঙ্কাল চুরির ঘটনা থেমে নেই: দেশের নানা স্থানে কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটে চলছে। বরিশাল, শেরপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহের ভালুকা, দিনাজপুর সদরের সুন্দরবন ইউনিয়ন, সিরাজগঞ্জের নাইমুড়ি গ্রাম, সাভারের আশুলিয়ায় গত পাঁচ বছরে অন্তত তিন হাজারের বেশি কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটেছে। তথ্য মতে, দেশের বাজারে বিক্রি করার পাশাপাশি কঙ্কাল চুরি করার পর সাধারণত পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করা হয় এসব কঙ্কাল।

এ ছাড়া ব্যতিক্রম ঘটনাও আছে, একটি চক্র ভারত থেকে খ- খ- অবস্থায় মানবকঙ্কাল দেশে নিয়ে আসে। এরপর এসবের হাড় জোড়া দিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করে। এ চক্রের সঙ্গে জড়িত আছেন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ডাক্তার-শিক্ষার্থী, বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের কয়েকজন মালিক ও সীমান্ত এলাকার কিছু চোরাকারবারি। এরা একেকটি কঙ্কাল ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে বিক্রি করে।

কঙ্কাল চোর চক্রের সঙ্গে জড়িত মাদকাসক্তরা: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মনে করেন, কঙ্কাল চোর চক্রের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার কতিপয় মাদকাসক্তের পাশাপাশি গোরস্থানের কবর খোঁড়াখুঁড়ির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা আছে। চোর চক্রের সদস্যরা অর্থের লোভে লাশ কবর থেকে তুলে রাসায়নিকের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত সম্পন্ন করে কঙ্কাল পাচারকারীদের হাতে তুলে দিচ্ছে। তারা দেশে এবং দেশের বাইরে এসব কঙ্কাল পাচার করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণা এবং লেখাপড়ার ক্ষেত্রে মানব কঙ্কালের প্রয়োজন। এ-সংক্রান্ত জটিলতা দূর করার পাশাপাশি কঙ্কালের বিকল্প উপকরণও সহজলভ্য করতে হবে। অন্যথায় এসব চক্র এবং লাশ চুরির ঘটনা থামানো সহজ হবে না।

কঙ্কাল পাচারকারীরা এখনো সক্রিয়: অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, কবর থেকে কঙ্কাল চুরির বিষয়টি প্রায়ই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। এ বিষয়ে নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়ার পরও কঙ্কাল চুরি থামছে না। কয়েক দিন আগে ময়মনসিংহে অভিযান চালিয়ে একটি বাসা থেকে কিছুসংখ্যক মাথার খুলিসহ দুই বস্তা কঙ্কাল উদ্ধার করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ থেকে বোঝা যায়, কঙ্কাল পাচারকারীরা এখনো সক্রিয়।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মানুষের কঙ্কালের চাহিদা থাকায় কঙ্কাল চুরির সঙ্গে যুক্ত চক্রটি এতটা সক্রিয়। ময়মনসিংহের গহিন অরণ্য ও পাহাড়ি জনপদ মানবদেহের কঙ্কাল প্রক্রিয়াকরণের নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কঙ্কাল চোর চক্রগুলো সক্রিয় থাকলেও তাদের ধরতে পুলিশের ভূমিকা নেই বললেই চলে। 

ধর্মীয় বিশ্লেষকেরা বলছেন, কবরের সঙ্গে মানুষের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে থাকে। কেউই চান না তার স্বজনের লাশ কবর থেকে চুরি হয়ে যাক। বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির লাশ চুরির বিষয়ে স্বজনরা অতিরিক্ত আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। নানা অন্ধবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির লাশ চুরির ক্ষেত্রে চোর চক্রের বাড়তি তৎপরতা লক্ষ করা যায়। চিকিৎসাবিষয়ক শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কাছে মানুষের কঙ্কালের চাহিদা রয়েছে এবং তা সংগ্রহের বৈধ কিছু নিয়মও রয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যেহেতু এ চক্রের সদস্যদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে, সেহেতু এদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নেই। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে কর্তৃপক্ষ অপরাধীদের শনাক্ত করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, এটাই কাম্য।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. এনামুল হক সাগর বলেন, কঙ্কাল চোর চক্রের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার কতিপয় মাদকাসক্তের পাশাপাশি গোরস্তানের কবর খোঁড়াখুঁড়ির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। চোর চক্রের সদস্যরা অর্থের লোভে লাশ কবর থেকে তুলে রাসায়নিকের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত সম্পন্ন করে কঙ্কাল পাচারকারীদের হাতে তুলে দিচ্ছে হয়তো। তবে এসব ক্ষেত্রে পুলিশ সতর্ক রয়েছে এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি রেখে পুলিশ কাজ করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক আজমীর হোসেন বলেন, মেডিকেল কলেজে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে মানব কঙ্কালের বিকল্প নেই। ছাত্রজীবনে আমাদের একটি কঙ্কালের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল এক হাসপাতালের পিয়ন। যদিও পরবর্তী সময়ে এ ঘটনায় বেশ ঝামেলাও পোহাতে হয়। আমাদের দেশে অবৈধভাবে মানবকঙ্কালের ব্যবসা হয়, এমন অভিযোগ অনেক আগে থেকেই আছে। বলা হয়, অবৈধ মানবকঙ্কাল ব্যবসায়ীরা বিভিন্নভাবে জোগাড় করে তা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিক্রি করে থাকে। সংগ্রহ করা কঙ্কাল দেশের বাইরেও পাচার হয়ে থাকে। এ কথা সত্য যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবৈধ মানবকঙ্কাল ব্যবসায়ীদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করে কোর্টের মাধ্যমে জেলে পাঠিয়ে থাকে।

তারপর অভিযুক্তরা জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার কঙ্কাল ব্যবসায় লেগে যায়। তবে মানবকঙ্কাল সংগ্রহে নীতিমালা প্রয়োজন আছে। তাহলেই মেডিকেলের ছাত্র-ছাত্রীরা আসল কঙ্কাল ব্যবহার করে উন্নত চিকিৎসাসেবা শিখতে পারবে। 

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!