- এক বছরেও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি আইনশৃঙ্খলা
- সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
দেশের আইনশৃঙ্খলায় পুলিশের সক্রিয়তা বাড়লেও গত এক বছরে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পুলিশ। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ক্ষমতাকালে বিতর্কিত ভূমিকায় প্রশ্নবিদ্ধ হয় পুলিশ। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। এতে নারী-শিশুসহ নিহত হন দেড় হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা। গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর তীব্র গণরোষে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পুরো পুলিশ বাহিনী, ভেঙে পড়ে শৃঙ্খলা। পুরো বাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক-অস্থিরতা। এরপর কেটে গেছে একটি বছর। দীর্ঘ এ সময়কালেও আইনশৃঙ্খলা প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যেভাবে পুলিশের ঘুরে দাঁড়ানো প্রয়োজনীয়তা ছিল, তা হয়নি। ফলে জনমনে স্বস্তি ফিরছে না, পুলিশ নিজেও স্বস্তি পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত স্থলে পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায় না। কারণ মানসিকভাবে ভেঙে পড়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে জনতার প্রতিশোধমূলক ‘মব ভায়োলেন্স’-এর ভয় এখনো কাজ করছে। যে কারণে পুলিশ এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে পারছে না।
ফলে দেশে চুরি-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না খোদ পুলিশও। তবে আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, এক বছরে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, যদিও কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি। তবে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে পুলিশের দমন-পীড়নসহ নানা কার্যক্রম নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠে। পুলিশ সম্পর্কে ব্যাপক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর ঢাকাসহ দেশের অন্তত ৪৫০টি থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তর, বিভিন্ন জেলা পুলিশের কার্যালয়, ট্রাফিক পুলিশ বক্সসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুর হয়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় অনেক থানা ভবনে। লুট করা হয় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম। অনেক পুলিশ সদস্য ইউনিফর্ম খুলে গাঢাকা দেন। কেউ কেউ দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় প্রবল ঝুঁকির মধ্যে সারা দেশের থানাগুলো কার্যত পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। দেশের সবচেয়ে বড় এই বাহিনীর সদস্যদের কর্মস্থল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছিল ইতিহাসে নজিরবিহীন একটি ঘটনা। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারের ঐকান্ত প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করে পুলিশ সদস্যরা। নিরাপত্তা শঙ্কায় দীর্ঘদিন দেশের থানাগুলোতে পাহারায় থাকেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক সূত্র বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলকালে পুলিশ সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন থানা, ফাঁড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়, লুট হয় আগ্নেয়াস্ত্র। এ সময় পুলিশকে কাজে ফেরানো এবং সক্রিয় করাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পুলিশকে কাজে ফেরানো হয়। সচল করা হয় ভেঙে পড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এরপর সামনে আসে অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, গুলি চালিয়েছিলেন, তাদের আইনের আওতায় আনার কাজও চলমান। এর সঙ্গে পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কারকাজ ও বাহিনীটিকে ঢেলে সাজানোর জন্য কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এরই অংশ হিসেবে রদবদলের মাধ্যমে সারা দেশে ৫০ সহস্রাধিক পুলিশের রদবদল করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ৬৩ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে। এ ছাড়া বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় ৫৫ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অন্যতম সমন্বয়ক মাকসুদ হক বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা ফিরেছে ঠিকই কিন্তু জীবনের স্বাধীনতা ব্যাহত হয়েছে। আগের মতো গুম-খুন না হলেও ছিনতাই, ধর্ষণ, প্রকাশ্য চাঁদাবাজি মানুষের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দৃঢ় না হওয়ার কারণে মব ভায়োলেন্স, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ বেড়েই চলছে। জুলাই বিপ্লবের পর শুরুর দিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি পুলিশে ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। কিন্তু তারপর থেকে প্রায় এক বছর হয়ে গেল এখনো পুলিশে যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছি, এটা আসলে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব একটা ভালো বার্তা দিচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও সক্রিয় ভূমিকা থাকা উচিত ছিল।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি শঙ্কার বিষয় স্বৈরাচারের পতনের পরেও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার কোনো উন্নতি একেবারেই হয়নি। সে কারণে শঙ্কাটার পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে। আমি যদি এখন মব ভায়োলেন্সের শিকার হই তাহলে কোনো প্রতিকার পাব না।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা পর্যাপ্ত না হওয়ায় জনমনে স্বস্তি ফিরছে না, তেমনি পুলিশ নিজেও স্বস্তি পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের প্রতি আস্থার ঘাটতি রয়ে গেছে। ফলে এক বছরেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটনকালে পুলিশ ডাকলে তাদের পাওয়া যায় না। পুলিশের আতঙ্ক দূর করে পুলিশের সার্ভিল্যান্স বাড়াতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গত এক বছরে খুনের মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৮৩২টি। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত খুনের মামলা হয় ১ হাজার ৯৩৩টি। আর আগের ছয় মাসে এ-সংক্রান্ত মামলা হয় ১ হাজার ৮৯৯টি। অন্যদিকে ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪-এর জুন পর্যন্ত ১১ মাসে সারা দেশে খুনের মামলা হয়েছে দুই হাজার ৭৪২টি।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত গত ১১ মাসে সারা দেশে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৭৮৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ডাকাতির ৬৪৭টি, দস্যুবৃত্তির ১৫৮৮টি, দাঙ্গার ১১২টি, নারী ও শিশু নির্যাতনের ১৩ হাজার ৭৯৮টি, অপহরণের ৮৪৬টি, ধর্ষণের ৪ হাজার ১০৫টি, পুলিশ আক্রান্তের ঘটনায় ৫২০টি, অন্যান্য কারণে রুজুকৃত ৭৩ হাজার ৮৪০টি, অস্ত্র আইনে ১ হাজার ৪৮০টি, মাদকদ্রব্যের ৩৯ হাজার ১৪২টি এবং চোরাচালানের ১ হাজার ৮২০টি মামলা।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর নানা রকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়েছে পুলিশ। জন-আকাক্সক্ষা পূরণে পুলিশ সদস্যরা অত্যন্ত আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দয়িত্ব পালন করছে। এক্ষেত্রে পুলিশের সাহস ও মনোবলে কোনো ঘাটতি নেই। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা শুধু পুলিশের নয়, আমাদের সবার। তাই পুলিশকে তার আইনানুগ দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা করা উচিত।
তিনি বলেন, পুলিশের মনোবল বৃদ্ধিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে ডিজিটাল নজরদারি এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, ৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ যে জায়গায় পৌঁছেছিল সেখান থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আরও সময় লাগবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি পুলিশকে ব্যবহারের চেষ্টা না করে তাহলে দ্রুতই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আগামী নির্বাচনের আগেই পুলিশ যথাযথ দায়িত্ব পালনের একটা জায়গায় পৌঁছবে। তবে পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর উন্নয়নের জন্য শুধু প্রশিক্ষণ নয়, বরং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন ও মূল্যবোধে পরিবর্তন আনা জরুরি। তাহলেই তারা জনগণের সেবক হিসেবে সত্যিকার অর্থে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার চলে যাবার পর থেকে এক বছরে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, যদিও কাক্সিক্ষত অবস্থায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কখনোই কাক্সিক্ষত অবস্থায় আসেনি। এই সরকার চেষ্টা করছে, আগামীতে যে সরকার আসবে তারা হয়তো আরও ভালো করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ৫ আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের যেভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা ছিল, তা হয়নি। এর অন্যতম কারণ গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অনেক পুলিশ সদস্য নৈতিক ও মনোবল সংকটে পড়েছে। তাদের কর্মকা- সমালোচিত ও বিতর্কিত হয়েছে। তাই এই পরিস্থিতি এত দ্রুত স্বাভাবিক হবে না। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে ভালো কাজের মাধ্যমে পুলিশকেই তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও বিতর্কের অবসান ঘটাতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :