ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে স্বস্তি ফিরেনি। নিরাপত্তার বিষয়ে জনমনে কমেনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলায় পুলিশের সক্রিয়তা অনেকাংশে বাড়লেও আইনশৃঙ্খলা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ষ এ সময়কালেও আইনশৃঙ্খলা প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যেভাবে পুলিশের ঘুরে দাঁড়ানো প্রয়োজনীয়তা ছিল, তা হয়নি। ফলে জনমনে স্বস্তি ফিরছে না। এ ছাড়া অভ্যুত্থানের লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৪০০ অস্ত্র ও আড়াই লাখের মতো গোলাবারুদ এক বছরেও উদ্ধার না হওয়ায় রয়েছে শঙ্কাও।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, সারা দেশে উচ্ছৃঙ্খল জনতার মাধ্যমে সংঘটিত ‘মব সন্ত্রাস’-এর ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক প্ররোচনায় পরিচালিত কিংবা সামাজিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে সংঘটিত এসব সহিংস কর্মকা-ে বহু মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানসমূহ এসব ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, যা মানবাধিকারের জন্য এক গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। আসকের দাবি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণে জনমনে নিরাপত্তাবিষয়ক উৎকণ্ঠা চলমান। এ ছাড়া দেশে চুরি-ডাকাতি, সড়ক-মহাসড়ক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না খোদ পুলিশও। তবে আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলছেন, এক বছরে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, যদিও কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি। তবে এই সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে পুলিশের দমন-পীড়নসহ নানা কার্যক্রম নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠে। পুলিশ সম্পর্কে ব্যাপক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর ঢাকাসহ দেশের অন্তত ৪৫০টি থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তর, বিভিন্ন জেলা পুলিশের কার্যালয়, ট্রাফিক পুলিশ বক্সসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুর হয়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় অনেক থানা ভবনে। লুট করা হয় অস্ত্র গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম। অনেক পুলিশ সদস্য ইউনিফর্ম খুলে গাঢাকা দেন। কেউ কেউ দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় প্রবল ঝুঁকির মধ্যে সারা দেশের থানাগুলো কার্যত পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। দেশের সবচেয়ে বড় এই বাহিনীর সদস্যদের কর্মস্থল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছিল ইতিহাসে নজিরবিহীন একটি ঘটনা। ৮ আগস্ট দেশের হাল ধরে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের ঐকান্ত প্রচেষ্টায় ধীরে ধীর কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করে পুলিশ সদস্যরা। নিরাপত্তা শঙ্কায় দীর্ঘদিন দেশের থানাগুলোতে পাহারায় থাকেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এরপর পর্যায়ক্রমে সারা দেশেই পুলিশের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছরের আগস্ট মাস থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত গত ১১ মাসে ৪৭১টি রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতায় ঘটনা ঘটেছে। এতে ১২১ জন নিহত এবং আহত হয়েছে ৫১৮৯ জন। রাজনৈতিক সংঘাতের ৯২ শতাংশ ঘটনায় বিএনপি, ২২ শতাংশ ঘটনায় আওয়ামী লীগ, ৫ শতাংশ জামায়াতে ইসলামী এবং ১ শতাংশে এনসিপির সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা শহরের ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজি; সিলেটের কোয়ারি ও নদনদী থেকে পাথর লুটপাট; সেতু বাজার ঘাট বালুমহল ও জলমহল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে।
টিআইবি জানিয়েছে, এসব সহিংসতার ঘটনার মধ্যে কিছু সহিংসতায় একাধিক দল জড়িত ছিল। আবার বিদ্যমান দলগুলোর মধ্যে দুটি দলের সহিংসতা ঘটেছে। এজন্য শতাংশ হিসাবে মোট ১২০ শতাংশ দেখা যাচ্ছে। মূলত কিছু ঘটনার দায় একাধিক দলের ওপর বর্তেছে, এজন্য হিসাবটা এমন হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গত এক বছরে খুনের মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৮৩২টি। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত খুনের মামলা হয় ১ হাজার ৯৩৩টি। আর আগের ছয় মাসে এ সংক্রান্ত মামলা হয় ১ হাজার ৮৯৯টি। অন্যদিকে ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪-এর জুন পর্যন্ত ১১ মাসে সারা দেশে খুনের মামলা হয়েছে দুই হাজার ৭৪২টি।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত গত ১১ মাসে সারা দেশে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৭৮৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডাকাতির ৬৪৭টি, দস্যুবৃত্তির ১৫৮৮টি, দাঙ্গার ১১২টি, নারী ও শিশু নির্যাতনের ১৩ হাজার ৭৯৮টি, অপহরণের ৮৪৬টি, ধর্ষণের ৪ হাজার ১০৫টি, পুলিশ আক্রান্তের ঘটনায় ৫২০টি, অন্যান্য কারণে রুজুকৃত ৭৩ হাজার ৮৪০টি, অস্ত্র আইনে ১ হাজার ৪৮০টি, মাদকদ্রব্যের ৩৯ হাজার ১৪২টি এবং চোরাচালানের ১ হাজার ৮২০টি মামলা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক সূত্র বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর পুলিশকে কাজে ফেরানো এবং সক্রিয় করাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পুলিশকে কাজে ফেরানো হয়। সচল করা হয় ভেঙে পড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এরপর সামনে আসে অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, গুলি চালিয়েছিলেন, তাদের আইনের আওতায় আনার কাজও চলমান। এর সঙ্গে পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কারকাজ ও বাহিনীটিকে ঢেলে সাজানোর জন্য কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পুলিশের অধিকতর জবাবদিহিতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এগুলো হলোÑ সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন জাতীয় পুলিশ কমিশন গঠন করা, পুলিশ অ্যাক্ট-১৮৬১ ও পিআরবি’র প্রয়োজনীয় সংশোধন করা, বিশেষায়িত ইউনিটের বিধিবিধান প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সংশোধন করা, জনপ্রত্যাশা পূরণে যুগোপযোগী ও নতুন আইন ও বিধি প্রণয়ন, বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিগুলোতে পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধিতে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এসব পদক্ষেপের ফলে দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে পুলিশি কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে দেশের জনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হয়েছে। একটি সুপ্রশিক্ষিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি জনবান্ধব পুলিশ হিসেবে সমসাময়িক বিভিন্ন অপরাধ কর্মকা- রোধের মাধ্যমে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও জনস্বস্তি আনয়নে সক্ষম হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আসকের সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, আইনের শাসন, আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বাছবিচারহীন গ্রেপ্তার, মব সন্ত্রাস ও সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ, নারীর প্রতি সহিংসতায় জিরো টলারেন্স বাস্তবায়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এই সংকট নিরসনে রাষ্ট্রকে এখনই কার্যকর, দায়িত্বশীল ও মানবাধিকারবান্ধব ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে জনগণের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত পরিবর্তনের স্বপ্ন ব্যর্থ না হয়।
মানবাধিকার সংগঠন আসক জানায়, দেশের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতেও একটি আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, বাংলাদেশ বলপূর্বক গুম থেকে রক্ষার আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে এবং পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্বে সংঘটিত গুমের অপরাধ তদন্তের জন্য একটি ‘গুম কমিশন’ গঠন করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য দায়বদ্ধতার পথে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদ- রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা পর্যাপ্ত না হওয়ায় জনমনে স্বস্তি ফিরছে না, তেমনি পুলিশ নিজেও স্বস্তি পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের প্রতি আস্থার ঘাটতি রয়ে গেছে। ফলে এক বছরেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি। পুলিশের আতঙ্ক দূর করে পুলিশের সার্ভিল্যান্স বাড়াতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অন্যতম সমন্বয়ক মাকসুদ হক বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা ফিরেছে ঠিকই কিন্তু জীবনের স্বাধীনতা ব্যাহত হয়েছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দৃঢ় না হওয়ার কারণে মব ভায়োলেন্স, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ বেড়েই চলছে। জুলাই বিপ্লবের পর শুরুর দিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি পুলিশে ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। কিন্তু তারপর থেকে প্রায় ১ বছর হয়ে গেল এখনো পুলিশে যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছি, এটা আসলে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব একটা ভালো বার্তা দিচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর নানা রকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে পুলিশ। জনআকাক্সক্ষা পূরণে পুলিশ সদস্যরা আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দয়িত্ব পালন করছে। এক্ষেত্রে পুলিশের সাহস ও মনোবলে কোনো ঘাটতি নেই। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা শুধু পুলিশের নয়, আমাদের সবার। তাই পুলিশকে তার আইনানুগ দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে।
তিনি বলেন, পুলিশের মনোবল বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে ডিজিটাল নজরদারি এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :