শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২৫, ০১:৩৩ এএম

সিসার নেশায় ধনীর দুলাল-দুলালিরা বুঁদ  

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২৫, ০১:৩৩ এএম

সিসার নেশায় ধনীর দুলাল-দুলালিরা বুঁদ  

  • অভিজাত এলাকায় সিসা লাউঞ্জের আড়ালে চলে মাদক ও রমরমা দেহব্যবসা
  • বৃহস্পতিবার ভোর রাতে ‘থ্রিসিক্সটি ডিগ্রি’ সিসাবারের সিঁড়িতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রাহাত হোসেন রাব্বি নামের এক যুবককে
  • মাত্র দেড় মিনিটে শেষ হয় রাব্বি কিলিং মিশন

চারদিকে আলো-আঁধারির খেলা। চার দেয়ালের মধ্যে হৈ-হুল্লোড় আর ছড়িয়ে পড়ছে ধোঁয়া। এমন পরিবেশে আরাম কেদারায় বসে বড় হুক্কায় সিসা টানছে ধনীর দুলাল-দুলালিরা। গানের তালে তালে বাড়তে থাকে নেশা। বিকেল গড়িয়ে রাত হতেই জমজামাট হয়ে ওঠে এই মিলনমেলা। অভিজাত পরিবারের উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীরাই এর প্রধান কাস্টমার। আইনের তোয়াক্কা না করে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও উত্তরায় প্রকাশ্যে চলছে এমন অসংখ্য সিসা বার বা লাউঞ্জ। ঢাকায় নামিদামি হোটেল-রেস্টুরেন্টে রয়েছে শতাধিক সিসা বার। এর মধ্যে শুধু বনানী ও গুলশানে রয়েছে প্রায় অর্ধশত অবৈধ সিসা বার। অনেক ক্ষেত্রে বারের অনুমোদন থাকলেও তারা মানছে না মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিয়মাবলি। এসব সিসা বারে রঙিন নেশায় রাত কাটাচ্ছেন উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই চলছে এসব সিসা বার।

জানা গেছে, বনানীর ১১ নম্বর রোড এবং এর আশপাশের গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্টের নামে অবৈধ সিসা বার। সন্ধ্যার পর যেখানে চলে উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা। প্রশাসনের নাকের ডগায় ‘সেলিসিয়া’, ‘সিগনেচার’, ‘থার্টি টু ডিগ্রি’, ‘থ্রিসিক্সটি ডিগ্রি’সহ অন্তত অর্ধশত সিসা বার চলছে গুলশান-বনানী এলাকায়। রেস্টুরেন্টের ভেতর আলাদা আলাদা কক্ষে সিসার পাশাপাশি চলে মাদক ও দেহ ব্যবসার রমরমা বাণিজ্যও। ফলে ক্রেতা ছাড়া প্রবেশের অনুমতি মেলে না কারো।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে সিসা একটি নিষিদ্ধ মাদক পণ্য। আইনে সিসা সেবন এবং বিক্রি নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত হোটেল ও রেস্টুরেন্টের সিসা বারগুলোয় হরদমে বিক্রি হচ্ছে মাদক পণ্য সিসা। এ ছাড়া নানা অনৈকিত কর্মকা- হয়ে থাকে এসব বারে। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর রাতে বনানীর ১১ নম্বর রোডের ১০০ নম্বর বাড়ির ‘থ্রিসিক্সটি ডিগ্রি’ সিসাবারের তৃতীয়তলার সিঁড়িতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রাহাত হোসেন রাব্বি নামের এক যুবককে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, যে সিসা বারে রাব্বিকে হত্যা করা হয়েছে ওই সিসাবারের এর আগে নাম ছিল এরাবিয়ান কজি। ‘এরাবিয়ান কজি’ নামে সিসা বারটি অধিদপ্তরের অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি নাম পরিবর্তন করে ‘থ্রিসিক্সটি ডিগ্রি’ নামে কৌশলে লুকিয়ে সিসাবার পরিচালনা করা হচ্ছিল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো (উত্তর) কার্যালয় কর্তৃক এর আগে বিভিন্ন সময় ওই সিসা বারে অভিযান চালানো হয় এবং এসব অভিযানে সিসা বারটির বিরুদ্ধে দুটি নিয়মিত মামলাও করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বনানীর ‘থ্রিসিক্সটি ডিগ্রি’ নামের একটি সিসা বার থেকে নামার সময় ভবনের সিঁড়িতে রাহাত হোসেন রাব্বিকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। মাত্র দেড় মিনিটের ওই কিলিং মিশনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

ছড়িয়ে পড়া ওই সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ভোর ৫টা ২৮ মিনিটে রাব্বি পকেটে দুই হাত ভরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছেন। এ সময় হাফ হাতা শার্ট পরিহিত একজন ও কালো টি-শার্ট পরিহিত দুই যুবক তার পেছনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলেন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কারো সঙ্গে রাব্বিকে কথা বলতে দেখা যায়। এর কিছুক্ষণ পর ৫টা ২৮ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে কালো টি-শার্ট পরিহিত আরেক যুবক নিচে নেমেই কোমর থেকে অস্ত্র বের করে রাব্বির মাথায় আঘাত করতে থাকেন। এ সময় রাব্বির সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নামা কালো টি-শার্ট পরিহিত যুবকরা এদিক-সেদিক ছুটতে থাকেন। ভোর ৫টা ২৮ মিনিট ৪২ সেকেন্ডে নিচ থেকে সিঁড়ি বেয়ে ধারালো অস্ত্র হাতে পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা পরিহিত এক যুবক লিফটের সামনে রাব্বিকে আঘাত করতে থাকে।

ওই সময় রাব্বির সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নামা কালো টি-শার্ট পরিহিত যুবক ফেরাতে গেলে পাঞ্জাবি পরিহিত যুবক তাকেও আঘাত করলে সে মাটিতে পড়ে যায়। এ সময় কালো টি-শার্ট ও পাঞ্জাবি পরিহিত তিন যুবক দৌড়ে এসে পুনরায় রাব্বিকে আঘাত করে রক্তাক্ত করে। ওই সময় ভবনটির ফ্লোর রাব্বির রক্তে ভেসে যায়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় রাব্বিকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বনানীর এ বাসার তলায় ‘থ্রিসিক্সটি ডিগ্রি’ সিসা বারটি রয়েছে। সেখান থেকে নামার সময় মুন্নাসহ কয়েকজন রাব্বিকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই রাব্বির মৃত্যু হয়।

বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার বলেন, ছুরিকাঘাত করা ব্যক্তিরা রাব্বির পূর্বপরিচিত। রাব্বিসহ অভিযুক্তরা প্রায়ই ওই সিসা বারে যেতেন। সিসা বার থেকে নামার সময় দ্বিতীয়তলার সিঁড়িতে আরও ৪-৫ জনের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয় রাব্বির। একপর্যায়ে রাব্বির বাম পায়ের উরুতে তিনটি ও ডান হাতে একটি ছুরিকাঘাত করা হয়।

এ ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি জানিয়ে ওসি সারোয়ার বলেছেন, ঘটনাস্থলের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ খতিয়ে দেখে জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয় (উত্তর) সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান জানান, সব সিসা বারই অবৈধ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রায় সময়ই অভিযান চালায়। কিন্তু কিছু দিন পরে আবার ভিন্ন নামে স্থান পরিবর্তন করে এসব সিসা বার পরিচালনা করা হয়। তিনি জানান, গত এক বছরে ঢাকা মেট্রো উত্তর কার্যালয় সিসা-সংক্রান্ত অন্তত ১০টি মামলা করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৮ এপ্রিল ধানমন্ডির ‘ওজং রেস্টুরেন্ট’ নামে একটি সিসা বারে অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা করা হয়। ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সিসা বার থেকে প্রায় ৪ কেজি সিসা ও ২০টি হুক্কা জব্দ করা হয়। গত ১৬ মে ‘হেজ’ নামে বনানীতে একটি সিসা বারে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে ৭ কেজি সিসা, ২৬টি সিসা সেবনের হুক্কা জব্দ করা হয়। এর আগে গত ১১ মার্চ ওই বারে অভিযান চালিয়ে ৫ কেজি সিসা ও ৪টি হুক্ক জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

গত ১১ মার্চে হবনব নামে একটি সিসা বারে অভিযান চালিয়ে ৬ কেজি ২০০ গ্রাম সিসা ও ৪টি হুক্কা জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় বনানী থানায় মামলা করা হয়। এ ছাড়া চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি বনানীর ক্লাব-৯২৯৪ নামে একটি সিসা বারে অভিযান চালিয়ে ৪ কেজি সিসা, ১০টি হুক্কা ও ৬ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়।

গত বছরের ২৮ মে বনানীর ‘দি সিলভার লাউঞ্জ’ নামে একটি বারে অভিযান চালিয়ে ৫ কেজি সিসা ও ১৩টি হুক্কা জব্দ করা হয়। এ সময় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

জানা গেছে, চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি বনানীর অ্যারাবিয়ারন কোজিতে অভিযান চালিয়ে ৪ কেজি সিসা, ৬ ক্যান বিয়ার ও ১১টি সিসা সেবনের হুক্কা জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

এ ছাড়া গত ১৭ মে রাজধানীর বনানীর ১১ নম্বর সড়কে অবস্থিত ‘হেজ’ সিসা লাউঞ্জে অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তার। সংশ্লিষ্টরা জানান, অভিযানে তালাবদ্ধ কক্ষে শতাধিক তরুণ-তরুণীকে বেসামাল অবস্থায় দেখতে পান অভিযানে থাকা কর্মকর্তারা। যেখানে উপস্থিত ছিলেন- চলচ্চিত্র অঙ্গনের উঠতি মডেল ও অভিনেত্রীরাও। অভিযানে লাউঞ্জের একটি কক্ষে কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে তরুণীদের নিয়ে সিসা সেবন করতে দেখা যায়। কর্মকর্তারা ওই কক্ষে প্রবেশ করলে তাদের ওপর চড়াও হন বিদেশি নাগরিকরা এবং ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স সংগ্রহের সময় মোবাইল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় সিসা লাউঞ্জ থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিএনসির কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, সিসায় দুই শতাংশের বেশি নিকোটিন পাওয়া গেলে, তা আইন অনুযায়ী মাদক হিসেবে গণ্য হয়। অথচ এসব লাউঞ্জে উচ্চমাত্রার নিকোটিনযুক্ত সিসা পরিবেশন করা হয়, যা তরুণদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, রাজধানীর পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, কলাবাগান, মিরপুর, বারিধারা, গুলশান, বনানী ও উত্তরায় শতাধিক অবৈধ সিসা বার রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরও অর্ধশতাধিক বার আছে। নামিদামি হোটেল ও রেস্টুরেন্টের নাম ব্যবহার করে কিছু প্রভাবশালী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চালাচ্ছেন এসব বার।

এ বিষয়ে বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার বলেন, ‘আমরা মঝেমধ্যেই অভিযান চালাই। গত মাসেও আমরা অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৬ কেজি সিসা জব্দ করেছি। আমরা কোনো তথ্য পেলেই অভিযান চালিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

সিসা বারের অধিকাংশ মালিক জানিয়েছেন প্রত্যেকটা সিসা বার থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও লোকাল থানাকে তারা ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে থাকে ঘুষ দিয়ে থাকেন, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে ওসি রাসেল সারোয়ার বলেন, ‘এটা আপনারা তদন্ত করে দেখেন। আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা পাবেন না। এসব বারের মালিকরা আমাদের ভয় পায়, এ ধরনের সুযোগ নিলে তারা ভয় পেত না। আমাদের এ অভিযান চলমান থাকবে বলে জানান ওসি।’

 

 

 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!