রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


সালমান ফরিদ, সিলেট

প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২৫, ১২:৩৯ এএম

সাদাপাথর লুট - ফাঁসতে পারেন ইউএনও

সালমান ফরিদ, সিলেট

প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২৫, ১২:৩৯ এএম

সাদাপাথর লুট - ফাঁসতে পারেন ইউএনও

** সাদাপাথর লুটপাটে প্রশাসনও দায়ি: দুদক

সাদাপাথর লুটপাট ঠেকাতে কার্যত কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা প্রশাসন। তিনটি দৃশ্যমান অভিযান ছাড়া লুটপাট প্রতিহত করতে বা ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে প্রশাসনের ঝুলিতে কোনো সফলতা নেই। একাধিক ভিডিও ফুটেজ ও ভিজ্যুয়াল গণমাধ্যমের খবরে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহারের সামনেই পাথর লুট হচ্ছে। তিনি নির্বিকার, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লুট হওয়া দেখছেন। কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। অ্যাকশনেও যাচ্ছেন না। চরম অবহেলা দেখা গেছে তার কার্যকলাপে। এটি স্বীকারও করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের দাবি, সিলেটের সাদাপাথর লুটপাটে প্রশাসনও দায়ি। স্থানীয় প্রশাসন নিজের দায় এড়াতে পারে না। তাদের চোখের সামনেই এতবড় কা- ঘটে গেছে।

এদিকে স্থানীয় একাধিক সূত্র দাবি করেছে, পুলিশ-বিজিবির মতো অনৈতিক সুবিধা পেত প্রশাসনও। নিয়মিত মাসোহারা যেত উপজেলা থেকে উপরমহল পর্যন্ত। এ কারণে পুরো সাদাপাথর, সংরক্ষিত বাঙ্কার এলাকা, ধলাই নদী, শাহ আরেফিন টিলা লুটেপুটে সাবাড় করে দিলেও তারা ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। লুট হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হলে টনক নড়ে। এই ব্যর্থতায় ফেঁসে যেতে পারেন কোম্পানিগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার। 

তবে নিজের ব্যর্থতা মানতে নারাজ তিনি। বলেন, ‘আমার সময় থেকে লুটপাট শুরু হয়নি। লুট আগে থেকে চলছে। আমি এসে ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। এজন্য দায়টা আমার ওপর দেওয়া যাবে না।’ তিনি এর চেয়ে বেশি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমনকি দুদকের বক্তব্য সম্পর্কেও কিছু বলতে চাননি। পরামর্শ দেন, ‘উপজেলা প্রেসক্লাবে আমি সব তথ্য দিয়ে দেব। আপনি সেখান থেকে সংগ্রহ করে নেবেন।’
আজিজুন্নাহার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় যোগদান করেন চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি বিকেলে। ১৫ জানুয়ারি থেকে তার কার্যকাল শুরু হয়। আর সাদাপাথর লুটপাট শুরু হয় ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে। তবে চূড়ান্ত খামচি বসানো হয় গত ৪ থেকে ৫ মাস ধরে।

সাদাপাথর থেকে পাথর লুটের বিষয়টি দেশব্যাপী আলোচিত হলে গত ১৩ আগস্ট বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায় দুদকের একটি দল। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন উপপরিচালক রাফি মো. নাজমুস সাদাত। তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথর থেকে নজিরবিহীন পাথর লুটের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনেন। বলেন, প্রাকৃতিক এই সম্পদ রক্ষা করার মূল দায়িত্ব ছিল স্থানীয় প্রশাসনের। তাদের আরও সতর্ক এবং কার্যকর ভূমিকা রাখা উচিত ছিল। 

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগেও নানা অভিযোগ উঠেছিল। প্রবাসীদের উদ্যোগে যৌতুকবিহীন গণবিয়েতে তার বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে কোম্পানীগঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন ইউকে। জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের (অনূর্ধ্ব-১৭) কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা দলের খেলোয়াড়দের যাতায়াত ভাতা ও দৈনিক ভাতা বিলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগও আসে তার বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে এসব অভিযোগ নিয়ে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে। 

ইউএনও আজিজুন্নাহারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্র থেকে ওঠা খাস কালেকশনের টাকা নয়-ছয় করার। পর্যটনকেন্দ্রে যেতে যেসব নৌকা ও গাড়ি পার্কিংয়ে খাস কালেকশন করা হয়, তার হার বাস্তবে অনেক বেশি হলেও দেখানো হয় সামান্য। দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের হাতে সোনালী ব্যাংক, কোম্পানীগঞ্জ শাখায় জমা দেওয়া একাধিক খাস আদায়ের রশিদ এসে পৌঁছেছে। যেখানে নামমাত্র টাকা জমা দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। পর্যটন উন্নয়ন তহবিলে খাস কালেকশন ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে জমা দেওয়ার রশিদ ছিল ১ লাখ ৮১ হাজার টাকার, ২৯ ডিসেম্বর ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৭০০ টাকা। কিন্তু তার দায়িত্ব নেওয়ার পর তা কমতে থাকে। ১৬ জানুয়ারি তারিখে ৬৫ হাজার ২৮০ টাকা, ৬ ফেব্রুয়ারি ৬৬ হাজার ৮১০ টাকা এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখের রশিদে দেখা যায় খাস কালেকশন জমা হয়েছে মাত্র ৬৩ হাজার ৪৬০ টাকা।  

একাধিক সূত্র জানায়, সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রে প্রতি নৌকা থেকে ট্রিপপ্রতি নেওয়া হয় ৪৫০ টাকা করে। দৈনিক গাড়ি পার্কিং এবং নৌকা থেকে গড়ে খাস কালেকশন হয় কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা। অথচ তহশিলদারের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয় তার চেয়ে অনেক কম। এই টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া হয়। 

উপজেলা প্রশাসনের এসব খাস কালেকশনের দায়িত্ব পালন করেন তহশিলদার গিয়াস উদ্দিন এবং ভূমি অফিসের নৈশপ্রহরী সুকুমার। খেটে খাওয়া পরিবারের সুকুমার আজ অদৃশ্য ইশারায় টাকার কুমিরে পরিণত হয়েছেন। গ্রামের বাড়িতে বানিয়েছেন অট্টালিকাসম প্রাসাদ। উপজেলা সদর ও জেলা শহরেও তিনি বাসাবাড়ির মালিক। 

সূত্রের দাবি, বালুমহাল থেকে উপজেলা প্রশাসনের নামেও আসে বড় অংকের কালেকশন। ধলাই নদী, বাঙ্কার সংরক্ষিত এলাকা, সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র, উৎমা ছড়া, শাহ আরেফিন টিলা, কালাইরাগ পাথর ও বালু মহাল থেকে দৈনিক হারে অর্থ কালেকশন করা হয় উপজেলা প্রশাসনের নামে। আর এই কালেকশন হয় মূলত  নৈশপ্রহরী সুকুমারের মাধ্যমেই। 

এদিকে জাতীয় গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সাদাপাথর লুটপাটে জড়িতদের নাম ও পরিচয় প্রকাশের পরও মামলায় তাদের নাম না উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা পরিচয় দেওয়ায় সমালোচনা করছেন অনেকে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও লিখছেন কেউ কেউ। স্থানীয়রা জানান, জেলা প্রশাসকের অফিস সাদাপাথর লুটের সাথে কারা জড়িত তার একটি তালিকা করেছে।

এটি প্রকাশ করা হয়নি। জেলা প্রশাসনে তালিকা থাকা ও সংবাদপত্রে লুটেরাদের নাম প্রকাশের পরও কেন অজ্ঞাতনামা আসামি করা হলোÑ প্রশ্ন তাদের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন প্রশাসনের প্রতি। খনিজ সম্পদ অধিদপ্তর শুক্রবার পাথর লুট ও চুরির ঘটনায় দেড় হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেছে কোম্পানীগঞ্জ থানায়। স্থানীয়দের দাবি, সরকারিভাবে প্রকাশ করা হোক লুটেরা এবং তাদের সহযোগীদের নাম-পরিচয়। 

সাদাপাথর শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও পরিচিতি সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রের। উজানের পাহাড় বেয়ে নেমে আসা পাথরের কারণে সাদাপাথরের সৌন্দর্যে পায় ভিন্ন মাত্রা। কখনো কখনো পাথরই হয়ে উঠে প্রধান আকর্ষণ। সেই পাথর লুটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে ঘটনা গড়ায় উচ্চ আদালত পর্যন্ত। আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, লুণ্ঠিত পাথর উদ্ধার করে আবার যথাস্থানে প্রতিস্থাপনের। এরপর টনক নড়ে প্রশাসনের। সারা দেশে শুরু হয় অভিযান। এসব অভিযানের ফলে কিছু পাথর উদ্ধার হয়েছে বটে, তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, লুণ্ঠিত পাথরের তুলনায় উদ্ধারের পরিমাণ অতিসামান্য। উদ্ধার অভিযানে গত শুক্রবার রাত পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৯ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার সম্ভব হয়। এগুলো সিলেটসহ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও আরও কিছু এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।

এর মধ্যে গত বুধবার সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে ১২ হাজার ঘনফুট, বৃহস্পতিবার ৩৭ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়। একই দিন নারায়ণগঞ্জ থেকে যৌথ অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় ৪০ হাজার ঘনফুট পাথর। গত শুক্রবার সকাল থেকে আবারও অভিযান শুরু করে গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন। অভিযানে গোয়াইনঘাটের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫ হাজার ঘনফুট ও কোম্পানীগঞ্জের কলাবাড়িসংলগ্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় ৮ হাজার ঘনফুট পাথর।
সাদাপাথর লুটের মামলায় গ্রেপ্তার ৫:  কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির পাথর ও সাদাপাথর লুট এবং চুরির ঘটনায় মামলায় ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল শনিবার সকালে কোম্পানীগঞ্জে একটি পাথরবাহী ট্রাকসহ ২ জন ও কালাইরাগ থেকে তিনজনকে পুলিশ অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) সুজন কর্মকার।

আড়াই লাখ ঘনফুট পাথর উদ্ধার: অবৈধভাবে লুট হয়ে যাওয়া বিপুল পরিমাণ পাথর উদ্ধার করেছে সদর উপজেলা প্রশাসন। গতকাল সকাল থেকে শুরু হওয়া অভিযানে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোশনূর রুবাইয়াত।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত কয়েকদিন আগেই পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ পাথর লুট করা হয়। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত বুধবার মধ্যরাত থেকে বিশেষ অভিযান শুরু হয়। অভিযান চলাকালে সাদাপাথরের বিভিন্ন স্থানে মাটি চাপা দেওয়া ও লুকানো অবস্থায় পাথর পাওয়া যায়, যা ধলাই নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সদর উপজেলা প্রশাসন জানায়, সদর উপজেলার বিভিন্ন ক্রাশার মিলে ও স্থানীয় বসতবাড়িতে সাদাপাথর এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। অভিযান চালিয়ে এসব স্থান থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পাথর উদ্ধার করা হয়।

সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোশনূর রুবাইয়াত বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমরা প্রায় ২০-২৫টি বাড়ি ও কয়েকটি ক্রাশার মিল থেকে আড়াই লক্ষাধিক ঘনফুট পাথর উদ্ধার করেছি। শুধু তাই নয়, যেসব বাড়ির মালিকরা ও যারা এই লুটপাটকা-ে জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!