ঢাকা শুক্রবার, ২২ আগস্ট, ২০২৫

রাজস্ব খাত সংস্কার  - অভিজ্ঞদের নেতৃত্বে রেখে অধ্যাদেশে বড় পরিবর্তন 

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৫, ০৫:৫৭ এএম

রাজস্ব খাতের সংস্কারের অধ্যাদেশে বড় সংশোধন আনা হয়েছে। বহুল আলোচিত অধ্যাদেশে মোট ১১টি সংশোধন আনার প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাস হয়েছে। অন্যতম প্রধান সংশোধন হলোÑ রাজস্ব নীতি বিভাগে রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে প্রধান করা হবে। 

একই সঙ্গে ‘যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও ন্যায্যতার’ ভিত্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে এবং ন্যস্ত করা জনবল থেকে প্রয়োজনীয় জনবল বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে রাজস্ব নীতি বিভাগে পদায়ন করা যাবে। এমন আরও ১০টি বিধান রেখে সংশোধনীর প্রস্তাব পাস হয়েছে। 

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুমোদন দেওয়া হয়। সভা শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের এই সংশোধনীর বিষয়ে অবহিত করেন।

গত ১২ মে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারির পর এর বিরোধিতা করে প্রায় দেড় মাসজুড়ে আন্দোলন করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত জুন মাসের শেষের দিকে দেশের শুল্ককর কার্যালয়ে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এমন অবস্থায় ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় আন্দোলন স্থগিত করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এখন এনবিআরে চলছে আন্দোলনের জেরে বরখাস্ত, বদলিসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

গত ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনাÑ এই দুটি বিভাগ করার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এরপর থেকে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে প্রায় দেড় মাস আন্দোলন করেন। অধ্যাদেশটি সংশোধনের জন্য গত ২৯ জুন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যাদেশ সংশোধনে প্রস্তাবে অনুমোদন দিল।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘আমরা অধ্যাদেশটি সংশোধনের বিষয়ে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছি। এগুলো হলোÑ যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও ন্যায্যতা। এর মানে হলো, যাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে তিনি যোগ্য কি না তা দেখা হবে; তিনি কাজটি সম্পর্কে অভিজ্ঞ কি না এবং যাকে কাজটি দেওয়া হচ্ছে তিনি ন্যায্য লোক কি নাÑ এসব বিষয়কে বিবেচনা করে সংশোধন করা হয়েছে’।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সব মিলিয়ে ১১টি সংশোধনী প্রস্তাব পাস হয়, সেগুলো হলোÑ ১. ধারা-৪ এর উপধারা (৩)। রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ বলা হয়েছিল, সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ করবে। এখন সংশোধন করে বলা হয়েছে, সরকার সামষ্টিক অর্থনীতি, বাণিজ্য নীতি, পরিকল্পনা, রাজস্ব নীতি বা রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ প্রদান করবে।

২. ধারা-৪ এর উপধারা (৪) এ আগে বলা হয়েছিল, রাজস্ব নীতি বিভাগের বিভিন্ন পদ আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, কাস্টমস, অর্থনীতি, ব্যবসা প্রশাসন, গবেষণা ও পরিসংখ্যান, প্রশাসন, নিরীক্ষা ও হিসাব এবং আইনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের থেকে পূরণযোগ্য হবে।

সংশোধনে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগের আয়কর নীতি, দ্বৈতকর পরিহার চুক্তি, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও মতামত, শুল্ক নীতি, মূল্য সংযোজন কর নীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কাস্টমসসংক্রান্ত চুক্তি অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণযোগ্য হবে।

৩. ধারা-৪ এর উপধারা (৪ ক) সংশোধনীতে একটি নতুন উপধারা সংযোজন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগের অন্য অনুবিভাগের পদে জনপ্রশাসন, অর্থনীতি, বাণিজ্য নীতি, গবেষণা ও পরিসংখ্যান, হিসাব ও নিরীক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ এবং আইন প্রণয়নসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা বা ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পূরণ করা হবে।

৪. ধারা-৫ এর দফা (চ) মূল অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, কর আইন প্রয়োগ এবং কর আহরণ পরিস্থিতির মূল্যায়ন। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি, কর ব্যয় ও রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতির প্রভাব বিশ্লেষণ।

৫. ধারা-৭ এর উপধারা (৩) মূল অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, সরকার রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতা আছেÑ এমন যোগ্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করবে। এখন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, সরকার রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতা আছেÑ এমন যোগ্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ প্রদান করবে। 

৬. ধারা-৭ এর উপধারা (৪) এর আগে বলা হয়েছিল, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের আয়কর, মূল্য সংযোজন কর ও কাস্টম আইন বাস্তবায়ন এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের বিভিন্ন পদে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (শুল্ক ও আবগারি) এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কর) ক্যাডারে কর্মরত জনবলের মধ্য থেকে নিয়োগ করা হবে। এখন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, কাস্টম আইন বাস্তবায়ন এবং মাঠপর্যায়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাসংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণযোগ্য হবে।

৭. ধারা-৭ এর উপধারা (৫) এর মূল অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন), বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কর), বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডার এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ রাজস্ব আহরণ ও জনপ্রশাসনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণযোগ্য হবে। এখন সংশোধন করা হয়েছে যে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ রাজস্ব আহরণ ও জনপ্রশাসনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণযোগ্য হবে।

৮. ধারা-৭ এর উপধারা (৬), এখানে আগে বলা হয়েছিল, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ কর্তৃক তপশিলে বর্ণিত আইনগুলো মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে নিয়োজিত পদগুলো বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কর), বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (শুদ্ধ ও আবগারি) ক্যাডারে কর্মরত কর্মকর্তা এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মচারীদের থেকে পূরণযোগ্য হবে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ কর্তৃক তপশিলে বর্ণিত আইনগুলো বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট মাঠপর্যায়ের পদগুলো রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মচারীদের থেকে পূরণযোগ্য হবে।

৯. ধারা-৮ এর দফা (জ), মূল অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, রাজস্ব ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত পদ্ধতি প্রণয়ন। সংশোধনীতে বলা হয়, রাজস্ব ব্যবস্থাপনাসংশ্লিষ্ট বিধিবিধান, প্রজ্ঞাপন, রুলিং, নীতিমালা, স্থায়ী আদেশ ও অন্য নির্দেশাবলি প্রণয়ন, সংশোধন ও তাদের ব্যাখ্যা প্রদান। 
১০. ধারা-৮ এর দফা (ট), মূল অধ্যাদেশে বলা হয়, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের আন্তঃশাখা এবং রাজস্ব নীতি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের মধ্যে আন্তঃসংযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্বিক অটোমেশন কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা। এখন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের অটোমেশন কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন এবং আন্তঃউইং, রাজস্ব নীতি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের মধ্যে আন্তঃসংযোগ প্রতিষ্ঠা।

১১. ধারা-৯, আগে বলা হয়েছিল, রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে এবং ন্যস্ত করা জনবল থেকে প্রয়োজনীয় জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগে পদায়ন করা যাবে। এখন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে এবং ন্যস্ত করা জনবল থেকে প্রয়োজনীয় জনবল বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে রাজস্ব নীতি বিভাগে পদায়ন করা যাবে।