গত কয়েকদিন ডেঙ্গুর প্রকোপে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও গতকাল বৃহস্পতিবার একসঙ্গে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩১১ জন। গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১১০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৭ হাজার ৭৮২ জন।
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৮২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৭ জন, ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় ৪২ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫১ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৬১ জন, খুলনায় ১৫ জন, ময়মনসিংহে ২ জন ও রাজশাহী বিভাগে ২১ জন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন।
সাধারণত জুন-জুলাই মাসকে বলা হয় ডেঙ্গুর প্রজনন মৌসুম। তবে বর্ষাকাল আরেকটু বিস্তৃত হলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরেও থাকতে পারে এর প্রভাব। কিন্তু চলতি বছর আগস্টে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কপালে ভাঁজ পড়াচ্ছে বিশেষজ্ঞদের। প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন রোগী। হাসপাতালে ভর্তিদের মধ্যে কেউ কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও বেশির ভাগই কাতরাচ্ছেন জ্বরে। সিটি করপোরেশন লোক দেখানো পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করলেও কার্যত মশা নিয়ন্ত্রণ কিছুই হচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর। আর সিটি করপোরেশন বলছে, নগরবাসীর অসচেতনতার কারণেই অনেক চেষ্টায়ও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণু বহন করে এডিস মশা। এই জাতের মশা নালা-নর্দমার নোংরা পানিতে জন্মায় না, বরং জন্মায় মানুষের ঘরের ভেতরে ও আশপাশে জমে থাকা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার পানিতে। ছাদে ও বারান্দায় জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে, গাছের টব, ডাবের খোসা ইত্যাদিতে জমে থাকা পানিতে। বর্ষাকালে প্রায়ই থেমে থেমে বৃষ্টি হয় বলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে। তাই জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটে থাকে এবং এটাকেই ডেঙ্গুজ্বরের মৌসুম বলা হয়। প্রাকৃতিকভাবে জুন থেকেই শুরু হয় ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজনন ঋতু।
তবে চলতি বছর আগস্ট মাসে আক্রান্তের হার উচ্চ পর্যায়ে থাকায় আশংকা প্রকাশ করছেন খোদ চিকিৎসকরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখন যে পরিস্থিতি আমরা দেখছি তাতে এটাকে সারা বছরের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করাই সমীচীন। এই রোগ সংক্রমণ ও বিস্তারের প্রকৃতি লক্ষ করলে এটা এড়ানোর কিছু উপায় আমরা সহজেই অবলম্বন করতে পারি। সেটা হলো, বাসাবাড়ির ভেতরে ও আশপাশে পানি জমতে না দেওয়া, যাতে এডিস মশার বংশ বিস্তার ঠেকানো যায়। দ্বিতীয়ত, মশার কামড় এড়ানোর জন্য সতর্ক থাকা, বাসা মশামুক্ত রাখার চেষ্টা করা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা।
বিশেষভাবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন শিশুদের ব্যাপারে। তাদের খালি গায়ে না রাখা, কেননা এডিস মশা সাধারণত শরীরের উন্মুক্ত অংশে বসে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সতর্কতার পাশাপাশি সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও বিশেষভাবে প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের ভূমিকাও কম নয় বলে উল্লেখ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা বরাবরই বলে আসছি ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি। যা বছর শুরুর আগেই করতে হয়। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি এখন শুধু নগরের রোগ নয়। এটি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ায় এটি এখন সারা বছরই থাকছে।
এ কারণেই কিন্তু কিউলেক্স মশার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের একটি জায়গায় ৯ শতাধিক কিউলেক্স মশার প্রজননস্থল পাওয়া গেছে।
প্রতিবছরই আমরা দেখছি সিটি করপোরেশন মশা প্রতিরোধে নানা ধরনের লম্ফঝম্প। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই চোখে পড়ে না। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নিয়মিত মশা নিধন অভিযান পরিচালনা করা। প্রজনন মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই উভয় সিটি করপোরেশনকে জরিপ চালিয়ে যেসব এলাকায় এলাকায় এডিস মশার ঘনত্বের সূচক বেশি পাওয়া সেসব এলাকা রেড জোন চিহ্নিত করে মশার ওষুধ ছিটানো, ওইসব এলাকার বাসা-বাড়িগুলোতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা; সর্বোপরি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার কাজটি সিটি করপোরেশনকে নিয়মিত করতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা জরুরি। বিশেষ করে নিজেদের বাড়ির গাছের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, বালতি, পানির চৌবাচ্চা ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে, সে জন্য সবাইকে সতর্ক হতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫১ জন এবং জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে সাতজন, মে মাসে তিনজন, জুনে ১৯ জন এবং জুলাইয়ে ৪১ জন মারা গেছেন। আর আগস্টে এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৮০২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন ২৭ জন।