এমবিবিএস, এফসিপিএস, জিটিসি (জাপান, ফ্রান্স), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফেলো (ব্যাংকক); উচ্চতর প্রশিক্ষণ (আমেরিকা ও জার্মানি); প্রাক্তন পরিচালক ও অধ্যাপক (রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগ)Ñ এমন কোনো বৈশি^ক ট্রেনিং নেই, যা ডাক্তার নামের কসাই জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. শেখ গোলাম মোস্তফার নামের সঙ্গে নেই।
প্রায় ১০ বছর আগে চাকরি থেকে অবসরে গেলেও থেমে নেই চেম্বার বাণিজ্য। যেখানে বেশির ভাগ চিকিৎসকই নতুন রোগীর ক্ষেত্রে ১ হাজার টাকা এবং পুরোনো রোগীর ক্ষেত্রে অর্ধেক ভিজিট রাখেন, সেখানে তিনি উভয় ধরনের রোগীর কাছ থেকেই একই ফি আদায় করেন। দায়িত্বে থাকাকালীন যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় পকেটে ঢুকিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। এক রেডিওথেরাপি মেশিন কিনেই আত্মসাৎ করেছেন শতকোটি টাকা। রাজধানীর মহাখালীর রিলায়েন্স মেডিকেল সার্ভিসেস নামের একটি হাসপাতালে বসে নিয়মিত রোগী দেখলেও স্বপ্ন দেখতেন রাষ্ট্র পরিচালনার। গ্রামের বাড়িতে গড়েছেন বিপুল সম্পদ। আর তাইতো কোটি টাকা খরচ করতেও নেই কোনো দ্বিধা। ছাত্র-সমন্বয়কের নামধারী ব্যক্তিদেরও ২০০ কোটি টাকা দিতে রাজি হয়ে যান এক নিমেষেই। ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবিÑ এই চিকিৎসককে কেউ চেনেনই না। উপদেষ্টা হওয়া তো দূরের কথা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা, ফুসফুস ক্যান্সারের চিকিৎসা, মুখ, গলা ও নাকের ক্যান্সারের চিকিৎসা, গর্ভাশয় ক্যান্সারের চিকিৎসা, প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসা, রক্ত ক্যান্সার (লিউকেমিয়া) চিকিৎসা, লিম্ফোমা ক্যান্সারের চিকিৎসা, হাড়ের ক্যান্সারের চিকিৎসা, পেট ও অন্ত্রের ক্যান্সারের চিকিৎসা, ইসোফ্যাগাস (খাদ্যনালি) ক্যান্সারের চিকিৎসা, মূত্রথলি ক্যান্সারের চিকিৎসা, কিডনি ক্যান্সারের চিকিৎসা, লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা, প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারের চিকিৎসা, ত্বকের ক্যান্সারের চিকিৎসা, ডিম্বাশয় ক্যান্সারের চিকিৎসা, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর ক্যান্সারের চিকিৎসা, শিশুদের ক্যান্সারের চিকিৎসা, অগ্ন্যাশয় ক্যান্সারের চিকিৎসা, থাইরয়েড ক্যান্সারের চিকিৎসা, টিউমারের চিকিৎসা (সৌম্য ও ম্যালিগন্যান্ট), রেডিওথেরাপি চিকিৎসা, কেমোথেরাপি চিকিৎসা, টার্গেটেড থেরাপি চিকিৎসা, ইমিউনোথেরাপি চিকিৎসা, প্যালিয়েটিভ কেয়ার ও ব্যথা নিয়ন্ত্রণ, ক্যান্সার স্ক্রিনিং ও প্রাথমিক শনাক্তকরণ, ক্যান্সার-পরবর্তী পুনর্বাসন, মুখের টিউমারের চিকিৎসা, গলার টিউমারের চিকিৎসা, বক্ষের টিউমারের চিকিৎসা, পেটের টিউমারের চিকিৎসা, হাড় ও জয়েন্টের টিউমারের চিকিৎসা, স্নায়ুতন্ত্রের টিউমারের চিকিৎসা, শিশুদের টিউমারের চিকিৎসা, মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সারের চিকিৎসা, জটিল ও বিরল ক্যান্সারের চিকিৎসা, অপারেশন-পরবর্তী ক্যান্সার কেয়ার, ক্যান্সার প্রতিরোধমূলক পরামর্শ ও জীবনধারা পরিবর্তনÑ এমন কোনো বিষয় নেই যার চিকিৎসা তিনি করেননি।
আওয়ামী লীগের সময় তদবির করে ২০১৪ সালের ১৯ মে থেকে একই বছরের ৩ আগস্ট পর্যন্ত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক এবং প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময়েই কেনা হয় ৬টি রেডিওথোরাপি মেশিন। যার বাজারমূল্য বর্তমান অর্থের হিসাবে ১৯৭ কোটি ৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। যদিও এগুলো জাপান থেকে সরাসরি কেনার কথা ছিল। কিন্তু অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে এই পরিচালক নামমাত্র মূল্যে চীন থেকে এগুলো কেনেন। ফলাফল সবগুলো মেশিনই এখন অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। একই অবস্থা এমআরআই মেশিনের ক্ষেত্রেও। তার সময়ে কেনা এমআরআই মেশিনটি এখন অকেজো সামগ্রীর মতোই পড়ে আছে হাসপাতালের একটি রুমে।
সম্প্রতি এই চিকিৎসকের ওপর অভিযোগ ওঠে উপদেষ্টা হতে সাবেক সমন্বয়ককে ২০০ কোটি টাকার চেক দেওয়ার। শুধু তা-ই নয়, দায়িত্বে থাকাকালীন ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের অভিযোগে বলা হয়, তিনি স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদ পাওয়ার প্রলোভনে একজন সমন্বয়ককে ১০ লাখ টাকা নগদ এবং ২০০ কোটি টাকার চারটি চেক প্রদান করেছেন। এই ঘটনা এ বছরের জানুয়ারিতে সংঘটিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এই অভিযোগ দেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, ডা. মোস্তফা ১০ লাখ টাকা নগদ এবং ২০০ কোটি টাকার চারটি চেক প্রদান করেছেন। এই লেনদেনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ছিলেন আরিফুল। এই গ্রুপ নিজেদের যমুনা থেকে আগত হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। আরিফুল ইসলাম সরাসরি ডা. মোস্তফার চেম্বার থেকে চেকগুলো সংগ্রহ করেন। যদিও আরিফুল সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না, তিনি ফোনে কথোপকথনের মাধ্যমে এই ডিল নিশ্চিত করেছেন বলে জানা গেছে।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক তদন্ত শুরু করেছে। দুদক সূত্রে জানা যায়, ডা. শেখ গোলাম মোস্তফার ব্যাংক হিসাব, আর্থিক লেনদেন এবং সমন্বয়ক গ্রুপের সঙ্গে তার যোগাযোগের রেকর্ড খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তকারী দল চেকগুলোর সত্যতা এবং লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য যাচাই করছে। দুদকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই অভিযোগ যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তবে এটি স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির একটি গুরুতর ঘটনা। আমরা এ বিষয়ে নিরপেক্ষ ও কঠোর তদন্ত পরিচালনা করছি।
তবে এই চিকিৎসকের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, আমিও মাত্র একজনের কাছ থেকে এই চিকিৎসকের ব্যাপারে শুনলাম। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না এবং যেহেতু তিনি অবসরে গিয়েছেন, সেহেতু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই। তবে আমরা দুদকের তদন্তের ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছি।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. শেখ গোলাম মোস্তফা সাংবাদিকদের বলেন, কিছু মানুষ আমাকে জোর করে উপদেষ্টা বানাতে চায় এবং মিথ্যা প্রলোভনে ও জোর করে চেকে স্বাক্ষর নেয়। তারা যেদিন আমার অফিসে এসেছিল, সম্ভবত তাদের দুজনের হাতে অস্ত্র ছিল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের দুর্নীতি রোধে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, আর্থিক লেনদেনের কঠোর নজরদারি এবং প্রশাসনিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে দুদকের তদন্তের ফলাফল দ্রুত প্রকাশ এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অস্ত্রধারী সমন্বয়কদের জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্তে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এ খাতে সাফল্য থাকা সত্ত্বেও রয়েছে সুশাসনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, যা স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কিছু জটিলতা আমাদের সামনে আসছে। এটি এমনই একটি জটিলতা। যদি দুদক তদন্তে সত্যতা পায় তাহলে নিশ্চয়ই আমরা তার সাজা চাই।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন