রংপুরের পীরগাছায় বিরল রোগে আক্রান্ত হয়েছে দুই শতাধিক মানুষ। এতে উপজেলা জুড়ে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিভাগকে পাশে পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন উপজেলার হাজারো মানুষ। এ বিষয়ে সির্ভিল সার্জন ডা. শাহিন সুলতানার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তিনি বলেন, যদি গবাদিপশু থেকে সংক্রমিত হয় তাহলে প্রাণিসম্পদ বিভাগ ব্যবস্থা নেবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠকর্মীরা প্রতিবেদন দিলে মেডিকেল টিম গঠন করা হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার পীরগাছায় গবাদিপশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছে বিরল প্রজাতির মারাত্মক এক রোগ। শরীরে প্রথমে ফুসকুড়ি হয়ে পরে ঘা হয়, এরপর তা থেকে তৈরি হয় গভীর ক্ষত। এমন উপসর্গ নিয়ে দিনের পর দিন মানুষ আক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রাণিসম্পদ দপ্তর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় সমস্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্স রোগের উপসর্গের সঙ্গে এই সংক্রমণের হুবহু মিল রয়েছে। তবে এখনো প্রাণিসম্পদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পীরগাছার সদর, তাম্বুলপুর, ছাওলা, পারুল, ইটাকুমারী ইউনিয়নসহ প্রায় পুরো উপজেলায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত সদর, ছাওলা ও তাম্বুলপুর ইউনিয়ন।
পীরগাছা উপজেলা সদরের অনন্তরাম বড়বাড়ি এলাকার বাসিন্দা সাবিনা আক্তার জানান, গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গরু ও ছাগল লালনপালন করতেন তিনি। সপ্তাহ দেড়েক আগে হঠাৎ তীব্র জ্বরে অসুস্থ হয়ে মারা যায় একের পর এক পশু। অসুস্থ গবাদিপশুর সেবা করতে গিয়ে তিনিও আক্রান্ত হন অজানা রোগে।
তিনি বলেন, ‘সপ্তাহ দেড়েক আগে হঠাৎ করেই একে একে সব গরু তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হয়। স্থানীয় পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পশুগুলোকে সুস্থ করে তুলতে সব ধরনের চেষ্টা করেও বাঁচতে পারিনি। তিন দিনের মধ্যে তিনটি গরু ও চারটি ছাগল মারা যায়। পরে হঠাৎ দেখি আমার হাতে ফুসকুড়ির মতো কী যেন উঠতেছে। দুই দিন যেতেই সেই ফুসকুড়ি বড় ঘায়ে পরিণত হয়। এখন প্রচ- যন্ত্রণা করে, চুলকায়। স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা চলছে।’
সাবিনার মতো পুরো পীরগাছায় এ অজানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। যাদের সবাই অসুস্থ পশুর সংস্পর্শে ছিলেন অথবা অসুস্থ পশু জবাই করার পর মাংস স্পর্শ করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, গত দেড় মাস ধরেই এমন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। এমনকি অসুস্থ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যাচ্ছে আক্রান্ত গবাদিপশুও। এতে জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
বিরল রোগে আক্রান্ত পঞ্চাশোর্ধ্ব জাহেদা বেগম বলেন, ‘১০ থেকে ১২ দিন আগে হঠাৎ ডান হাতের একটি আঙ্গুলে চুলকানি শুরু হয়। পরে আস্তে আস্তে ফুসকুড়ি হয়ে ঘা। এখন ওই জায়গার মাংস পচে গিয়ে কালো হয়ে গেছে। ভেতরে প্রচ- জ্বালাপোড়া করে। নতুন করে আরও একটি আঙ্গুলে একইভাবে চুলকানি শুরু হয়েছে।’
ছাওলা ইউনিয়নের কৃষক আজিজুল হক বলেন, ‘পশু অসুস্থ হলে তার পরিচর্যা করতে হয়। বেশি অসুস্থ হলে অনেকে জবাই করে বিক্রি করেন। সেই মাংস কিনে খাওয়ায় অনেকে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। খাওয়ার দু-চার দিন পর শরীরে বড় বড় ঘা হয়।’
তাম্বুলপুর ইউনিয়নের জয়নাল মিয়ার ভাষ্য, ‘তার চাচা গরু জবাই করে মাংস দিয়েছিলেন। তা ধুয়ে রান্না করায় তার স্ত্রীর হাতে ঘা হয়েছে। চাচার বাড়ির যারা মাংস নাড়াচাড়া করেছেন, সবাই আক্রান্ত হয়েছেন।’
পীরগাছা সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, ‘মাস দেড়েক আগে একটি ছাগলের প্রচ- জ্বর আসে। অনেক চেষ্টার পরেও বাঁচার কোনো সম্ভাবনা না থাকায় ছাগলটাকে জবাই করি। ওই মাংস কাটাকাটি করার পরের দিন থেকে হাতে ছোট ছোট ফুসকুড়ি ওঠা শুরু হয়। পরে তা বড় ঘায়ে পরিণত হয়ে শেষের দিকে পচে যায়। অনেক ওষুধ খাওয়ার পর এখন একটু সুস্থ। স্থানীয় চিকিৎসক বলেছেন এটা নাকি অ্যানথ্রাক্স রোগ।’
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার আঁখি সরকার বলেন, প্রায় প্রতিদিনই এমন রোগে আক্রান্ত ৫ থেকে ৭ জন রোগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসেন। অনেক সময় একই পরিবারের সব সদস্য আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এখন পর্যন্ত পরীক্ষা করা না হলেও অ্যানথ্রাক্স রোগের উপসর্গের সঙ্গে এই সংক্রমণের হুবহু মিল রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে পুরো উপজেলায় এই রোগে সাধারণ মানুষ আক্রান্তের পাশাপাশি কয়েকশ’ গবাদিপশু আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও নির্বিকার উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর।
স্থানীয়রা জানান, খামারিদের কাছে যাওয়া তো দূরের কথা এমন সমস্যা নিয়ে প্রাণিসম্পদ দপ্তরে গেলে বেশির ভাগ সময়ই কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায় না। ফলে সঠিক চিকিৎসা না মেলায় মারা যাচ্ছে আক্রান্ত পশুগুলো। অন্যদিকে আক্রান্ত হলেই তড়িঘড়ি করে ওই পশুকে কম দামে হলেও বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন খামারিরা। এতে খামারিরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনি আক্রান্ত পশুর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ।
রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবু ছাঈদ বলেন, এটা একটা ‘জেনেটিক ডিজিজ’। এখানে মূল সমস্যা করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। একজন মেডিকেল অফিসার অথবা প্যারামেডিক জানে এটা কী হতে পারে। এই রোগ নিয়ে যখন সাধারণ মানুষ চিকিৎসা নিতে গেছে সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো উচিত ছিল। তাহলে শুরু থেকেই এই সমস্যা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে সুবিধা হতো। এখন সবার আগে আমাদের কাজ হলো এই রোগ শনাক্ত করা।
এদিকে এই রোগ শনাক্তের পাশাপাশি প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না গেলে মহামারিতে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
জনস্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি বেলাল হোসেন বলেন, ‘এমন উপসর্গ নিয়ে দিনের পর দিন মানুষ আক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রাণিসম্পদ দপ্তর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় সমস্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই যা ধারণা করা হচ্ছে, দ্রুত শনাক্তের মাধ্যমে যদি তা নিশ্চিত হওয়া যায় তাহলে এই সমস্যা সমাধান দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে এই সমস্যা মহামারি আকার ধারণ করে পুরো দেশে ছড়িয়ে পারবে।’
এ বিষয় নিয়ে রংপুরের জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সালের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ওই এলাকা থেকে আমাকে ফোনে জানানো হয়েছে। আমি স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেব। আপাতত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি তদারকি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন