ঢাকা শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সরকারি ক্রয় সংস্কার প্রক্রিয়া

আইনি বেড়াজালে আটকে যেতে পারে উদ্যোগ

হাসান আরিফ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৫, ১১:৫০ পিএম

বিধিবদ্ধ সব প্রতিষ্ঠানের বড় কেনাকাটা ক্রয় কমিটির মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এমনকি যেসব প্রতিষ্ঠানে সরকারের শেয়ার আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটাও এর আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বলছে, এই উদ্যোগ নিতে হলে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিএ) সংশোধন করতে হবে। নয়তো সরকারের নেওয়া উদ্যোগ মন্ত্রিপরিষদ (উপদেষ্টা পরিষদ) সভায় অনুমোদন করা সম্ভব হবে না।

এই বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিধিবদ্ধ সব প্রতিষ্ঠানের বড় কেনাকাটা ক্রয় কমিটির মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ব্যাপক জটিলতা তৈরি হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ইউনিলিভার বাংলাদেশ বা কোকা-কোলাতেও সরকারের শেয়ার আছে। এই আইন পাস হলে প্রতিষ্ঠান দুটি বড় কোনো কেনাটাকা করলেও ক্রয় কমিটির অনুমোদন লাগবে। তাহলে এ জাতীয় যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তারা কি ক্রয় কমিটির অনুমোদনের জন্য কেনাকাটা বন্ধ করে রাখবে?

তিনি বলেন, এ জন্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা সংশোধন আগে সংশোধন করতে হবে। এরপর এই উদ্যোগ নিতে হবে। নয়তো যেসব প্রতিষ্ঠানে সরকারের শেয়ার আছে ওই সব কোম্পানির ব্যাবসায়িক স্বাধীনতা সীমিত হওয়ার শঙ্কাও তৈরি হবে।

জানা গেছে, সরকার চাচ্ছে যেসব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের কেনাকাটা ক্রয় কমিটির অনুমোদন নিয়ে করতে হবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনে যেসব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান আছে তাদের কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম হয়। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটার জন্য ক্রয় কমিটির অনুমোদন নিতে হয় না। তারা বড় বড় প্রকল্পের জন্য তাদের মতো করে কেনাকানা করে। ফলে এসব কেনাকাটায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যাপক অভাব থাকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের ক্রয়প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে নানা সমালোচনার মুখে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জবাবদিহির অভাব এবং স্বচ্ছতার ঘাটতিÑ সব কিছু মিলিয়ে এ খাতকে প্রায়ই বলা হয় ‘সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর একটি’। এই প্রেক্ষাপটে সরকারি অর্থের ব্যবহার আরও কার্যকর ও স্বচ্ছ করার উদ্দেশ্যে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ/মন্ত্রিসভা কমিটির কার্যপরিধি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর অধীনে নিবন্ধিত সরকারি বা যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ক্রয় কার্যক্রমকেও এখন এই কমিটির আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারের বিনিয়োগ, লাভ-ক্ষতি ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে এসব কোম্পানির কার্যক্রম সরাসরি সম্পর্কিত হওয়ায়, তাদের ক্রয় কার্যক্রমও কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারির আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ/মন্ত্রিসভা কমিটির কার্যপরিধি সংশোধনের প্রস্তাব এখনো আলোচনার পর্যায়ে। আইএমইডি, অর্থ বিভাগ, বিপিপিএ ও লেজিসলেটিভ বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে তা চূড়ান্ত করে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখে, এই আইন পাস করতে হলে আগে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা সংশোধন করতে হবে। নয়তো পুরো উদ্যোগই জটিলতার মধ্যে পড়বে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চলতি মাসের মাঝামাঝি সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি সভাও করেছে। ওই সভায়ও আগে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা সংশোধন করার বিষয়ে মত দেওয়া হয়েছে।

সভার আলোচনায় সবাই এক মত, যদি প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়, তবে সরকারি ও যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানির বিপুল আর্থিক কার্যক্রম নজরদারির আওতায় আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ঝুঁকি হ্রাস পাবে, কিন্তু একই সঙ্গে কোম্পানিগুলোর ব্যাবসায়িক স্বাধীনতা সীমিত হওয়ার শঙ্কাও তৈরি হবে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রস্তাব: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত ৪ আগস্ট জারি করা পত্রে জানায়Ñ অর্থ বিভাগের সুপারিশ অনুযায়ী সরকারি অর্থের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এবং সরকারের প্রচ্ছন্ন দায় হ্রাস করতে সরকারি বা যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানির ক্রয় কার্যক্রমও উপদেষ্টা পরিষদ বা মন্ত্রিসভা কমিটির কার্যপরিধির অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।

ওই পত্রে বলা হয়, সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ যেসব কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার বা মালিকানা রয়েছে, তাদেরও কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন প্রক্রিয়ার আওতায় আনা প্রয়োজন।

আইএমইডির মতামত:

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রেরিত পত্রে জানায়Ñ ‘যেহেতু কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর অধীনে নিবন্ধিত সরকারি বা যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানিতে সরকারের বিনিয়োগ থাকে এবং এর লাভ-ক্ষতি সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু অন্যান্য সরকারি ক্রয় প্রস্তাবের মতো এসব কোম্পানির ক্রয় কার্যক্রমও উপদেষ্টা পরিষদ বা মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে ন্যস্ত করা যেতে পারে।’ তবে আইএমইডি সতর্ক করে দিয়ে জানিয়েছে, প্রস্তাব কার্যকর করতে হলে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন (পিপিএ) ২০০৬ এবং সংশ্লিষ্ট বিধি বা উপবিধি সংশোধন জরুরি হবে।

আইনি কাঠামো:

পিপিএ ২০০৬-এর ধারা ৩(২)-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছেÑ সরকারি, আধা-সরকারি বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার ক্রয় এ আইনের আওতাভুক্ত। কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর অধীনে নিবন্ধিত কোনো কোম্পানি সরকারি তহবিল ব্যবহার করে ক্রয় করলে তা-ও এ আইনের আওতাভুক্ত হবে।

তবে বাস্তবে সরকারি যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানির অনেক ক্রয় কার্যক্রম এই আইনের বাইরে থেকে যায়। কারণ, তাদের ব্যাবসায়িক স্বাধীনতা ও শেয়ারহোল্ডার কাঠামোর কারণে তারা সরাসরি সরকারি সংস্থা হিসেবে বিবেচিত হয় না। এ কারণেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ মনে করছেÑ কমিটির কার্যপরিধি সংশোধন করলে এ ফাঁকফোকর বন্ধ করা সম্ভব হবে।

নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া:

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ, আইএমইডি এবং বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) মতামত চেয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ সরকারি যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানির ক্রয় কার্যক্রমকে কেন্দ্রীয় অনুমোদনের আওতায় আনা হলে তাদের ব্যাবসায়িক স্বায়ত্তশাসন কতটা সীমিত হবে।

অতীতের অভিজ্ঞতা ও বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ:

বাংলাদেশের সরকারি ক্রয় খাত বরাবরই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নজরে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বারবার উল্লেখ করেছেÑ সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির অন্যতম কারণ।

বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার ৩০ শতাংশের বেশি ব্যয় অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের কারণে অপচয় হয়।

অন্যদিকে টিআইবির ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি ক্রয়ে রাজনৈতিক প্রভাব, কোটাবাজি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ ব্যাপকভাবে বিরাজমান। এসব কারণে সরকারের আর্থিক দায় ও ঝুঁঁকি বাড়ছে।

পূর্ববর্তী নীতিগত সংশোধন:

বাংলাদেশে সরকারি ক্রয়ের আইনগত কাঠামো প্রথম আসে ২০০৩ সালে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন (পিপিআর) প্রণয়নের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে ২০০৬ সালে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন (পিপিএ) পাস করা হয়। ২০০৮ সালে বিধি-উপবিধি সংশোধন করা হয়, এরপর বিভিন্ন সময়ে সংশোধনী যোগ হয়।

তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বা যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো বরাবরই এ ব্যবস্থার বাইরে থেকে গেছে। এর ফলে সড়ক, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও শিল্প খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত:

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ ইতিবাচক হলেও বাস্তবায়নে নতুন জটিলতা তৈরি হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিনা হোসেন বলেন, সরকারি যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চাইলে তাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় অনুমোদনের বেড়াজালে তারা যদি জড়িয়ে পড়ে, তবে ব্যাবসায়িক গতি কমে যেতে পারে।

অন্যদিকে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। তবে শুধু আইন সংশোধন যথেষ্ট নয়। বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।