রাজধানীতে সিসা বারের আড়ালে হরহামেশা চলছে ভয়ঙ্কর মাদক সেবন। মদ, গাঁজা, হিরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন প্রকারের ব্যবহার হয়ে এসব বারে। ধনীর দুলাল-দুলালিরা রাত গভীর হলেই বিনোদনের জন্য এসব সিসা বারে ভিড় করে। সেখানে চলে অসামাজিক কার্যক্রম। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ৬ মাসে রাজধানীর বিভিন্ন সিসা বারে অভিযান পরিচালনা করে অর্ধ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীতে বেশ কিছু অবৈধ সিসা বারে অভিযান চালিয়ে এসব অপর্কমের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। এরপর সংস্থাটি জানায়, গত বুধবার সন্ধ্যার পর গোপন তথ্যের ভিত্তিতে বনানীর ১৭ নম্বর রোডের ডেল্টা ডালিয়া বিল্ডিংয়ের হাবানা সিসা বারে অভিযান চলে। এই অভিযানে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সিসা বারটিতে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে হুঁকো ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য সরবরাহ করা হতো।
গোয়েন্দা ও ডিএনসির সূত্রমতে, রাজধানীর নামধারী সিসা বারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোÑ আল-গ্রিসিনো সিসা বার, এরাবিয়ান কোজি, সেলসিয়াস, সিসা এরাবিয়ান কোজি, ক্লাব-৯২৯৪ সিসা বার, হেজ, হবনব, হেজ সিসা বার, দ্য সিলভার লাউঞ্জ, হাবানা সিসা, ওজং রেস্টুরেন্ট। এগুলোসহ সারা ঢাকায় প্রায় দুই শতাধিক অবৈধ সিসা বার রয়েছে। অনেক সময় সিসা বারের নাম পরিবর্তন করে কৌশলে স্থান পরিবর্তন করে কার্যক্রম চালায়। এভাবে সিসার আড়ালে বছরের পর বছর ধরেই প্রশাসনের নাকের ডগায় অনৈতিক কার্যকলাপ চলে আসছে। তবে যারা এসব সিসা বার পরিচালনা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান শুরু করেছে। সমাজে এমন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে শক্ত অবস্থানে ডিএনসি ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশসহ ডিএনসির গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, এসব সিসা বার নিয়ন্ত্রণ করেন একশ্রেণির অসাধু রাজনৈতিক নেতা। ধনীর দুলাল-দুলালিরা খদ্দেরের তালিকায় শীর্ষে। অনেক সময় এসব তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। সূত্রমতে, সিসা বারের আড়ালে অপরাধ বেশি হয় খোদ রাজধানীর বনশ্রী, মোহাম্মাপুর, গুলশান-বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডিসহ বেশ কিছু আবাসিক এলাকায়। এসব জায়গায় দিনের পর দিন এসব অনৈতিক কর্মকা- চলে এলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিকার। তবে এসব এলাকায় বসবাসরত ও সচেতন মহলের দাবি, ঢাকায় যেসব সিসা বার চলে, এর সব তথ্য পুলিশ ও সরকারের অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা জানেন। তবে এসব নিয়ন্ত্রণে তাদের তেমন কোনো আইনগত উদ্যোগ নেই।
গত মাসে বনানীর একটি সিসা বার থেকে রাহাত হোসেন রাব্বি নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ওই যুবক খুন হওয়ার পর টনক নড়ে পুলিশ, ডিএনসিসহ সরকারের বিভিন্ন মহলের। ওই ঘটনার পর থেকে বন্ধ রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় থাকা সিসা বারগুলো। তবে অভিযোগ আছে, সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের টাকা দিয়ে এবং আইনের ‘ফাঁকফোকর’ ব্যবহার করে নিয়মিত সিসা বারগুলোর কার্যক্রম চলছেই। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে একযোগে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কিছু কিছুর বিরুদ্ধে চলতি মাসে অভিযানে নেমেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) তারিক লতিফ রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বনানীসহ রাজধানীতে গড়ে ওঠা অবৈধ সিসা বার বন্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা করলেও এ সময় পুলিশ সঙ্গে থাকে। তা ছাড়া এসব অবৈধ সিসা বার বন্ধের অভিযানে ডিএমপির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সমাজ থেকে এসব অপরাধ দমনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সব সময় কঠোর অবস্থানে রয়েছে। শিগগির অবৈধ সিসা বারের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, রাজধানীর উত্তরা, বনশ্রী, গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডি এলাকায় শতাধিক সিসা বার রয়েছে। এগুলোর তালিকা পুলিশসহ সব গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আছে। এখানে সিসার হুঁকার ভেতরে গাঁজাও সেবন করা হয়। পাশাপাশি নিয়মিত ইয়াবার আসর বসানো হয়, চলে মদ-ফেনসিডিল সেবন। এ ছাড়া রাত গভীর হলে চলে ভিআইপিদের আনাগোনা ও অসামাজিক কার্যক্রম। খদ্দেরের তালিকায় কালোটাকার মালিক ও ধনী পরিবারের দুলাল-দুলালিরা।
বাংলাদেশ বার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেজর (অব.) জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, আরব দেশের আদলে দেশে সিসা বার চালুর কথা ছিল। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা আলোচনায় থাকলেও অনুমোদন মেলেনি। অথচ আবাসিক ভবনেও গড়ে উঠছে অবৈধ সিসা বার। এর দায় পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এড়াতে পারে না। কিছু অসাধু রাজনৈতিক ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের শেল্টারেই এসব অপর্কম চলছে। আইনে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সিসা বার বেড়েছে দ্বিগুণ হারে, যেটা থানার পুলিশসহ প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে।
আইনগত তথ্যমতে, সিসা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ‘খ’ শ্রেণির মাদক কন্ট্রোল আইটেম। এটাকে নিকোটিন-জাতীয় মাদক বলা হয়। সাধারণ সিসার ফ্লেভারে শূন্য দশমিক ২ শতাংশের ওপরে নিকোটিন পাওয়া গেলেই তাকে মাদক হিসেবে গণ্য করা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অন্তত ২৩টি অভিযানে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ নিকোটিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ‘সিসা’ বা ‘হুঁকা’ সামাজিকভাবে বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, দেশে সিসা বার পরিচালনার কোনো বৈধ অনুমতি নেই। তবু শহরের অভিজাত এলাকায় লাইটিং ও অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার আড়ালে চলে এসব বার। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এমনকি চাকরিজীবী তরুণদেরও যাতায়াত থাকে এসব জায়গায়। অধিকাংশ সিসা বার সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। নামমাত্র খাবারের আড়ালে বসে নেশাখোরদের আসর। শুধু ফ্লেভারযুক্ত তামাক নয়, সিসার সঙ্গে মেশানো হয় ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলের নির্যাস কিংবা লিকুইড কোকেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মেহেদী হাসান রূপালী বাংলাদেশকে জানান, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকবলের স্বল্পতার কারণে অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। তার পরও আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। সিসা বারের আড়ালে মাদক সেবনকারীদের আইনের আওতায়ও আনছি। তিনি বলেন, ঢাকায় অবৈধ সিসা বারের আড়ালে চলছে অনৈতিক কার্যকলাপ। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে শক্ত অবস্থানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আমাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার (মুখপাত্র) কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে জানান, মাদকের বিরুদ্ধে র্যাব সব সময় আপসহীন কাজ করে। আমাদের র্যাব এসব বিষয়ে কঠোর অবস্থানে। শিগগির অবৈধ সিসা বারের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোনোভাবেই এই অবৈধ কার্যক্রম করতে দেওয়া হবে না। গোয়েন্দা তথ্য ও গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে মাঠে কাজ করছে র্যাব।