আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেটি ধরে নিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। জামায়াতের রাজনৈতিক বিভিন্ন পদক্ষেপের বিপরীতে বিএনপি এগোচ্ছে ভিন্ন কৌশলে। প্রতিটি আসনে বিএনপির একাধিক প্রার্থী নির্বাচনি প্রচার চালালেও তপশিলের আগেই ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ আসনে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করে ঘোষণা দেওয়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি চলছে। এ ছাড়া ‘জোট’ কিংবা ‘সমঝোতার জন্য রাখা হবে ৩০ শতাংশ আসন। এরই মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট নেতাদের। তারা সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছেন। নানা উইং থেকে তুলে আনা হচ্ছে আসনভিত্তিক মাঠের প্রকৃত চিত্র। বিএনপির একাধিক শীর্ষ নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য। বিএনপি নেতারা বলছেন, কোনো আসন চূড়ান্ত না হলেও আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে থাকছে চমক। বাদ পড়তে পারেন অনেক সিনিয়র নেতাসহ হেভিওয়েট প্রার্থীরা। এ ক্ষেত্রে মূল্যায়ন করা হবে ত্যাগী, সৎ ও যোগ্যদের।
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। নির্বাচনি বিধিতে তপশিলের আগে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করার বিধান নেই বিধায় আনুষ্ঠানিকভাবে নাম ঘোষণা করতে পারছে না দলটি। তবে প্রতিটি এলাকায় দেখা মেলে জামায়াত নেতাদের পোস্টার-বিলবোর্ড। আর তাতেই বোঝা যায় দলটির নির্বাচনি প্রস্তুতি কতটুকু। শুধু সংসদ নির্বাচন নয়। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে জয়ে বেশ চাঙা জামায়াত। জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা এমনকি ইউপি নির্বাচনের জন্য প্রার্থীর নাম ঠিক করে ফেলেছে দলটি। জুলাই-আগস্ট মাস থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে প্রচার চালাচ্ছেন। এমননি বাসায় গিয়ে নারীদের কাছে জামায়াতের পক্ষে ভোট চাইছেন নিয়মিত। বনশ্রী এলাকার গৃহিনী শিখা আক্তার জানান, আগস্ট মাসের শুরুর দিকে রাতে কয়েকজন নারী এসে কলিং বেল দিয়ে জানান তারা জামায়াতের ছাত্রী সংস্থার কর্মী। আগামী নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লা মার্কায় ভোট চান তারা। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রায় রাতেই এশার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে দাঁড়িপাল্লা বলে মিছিল করেন জামায়াতের কর্মীরা। নামাজ শেষে বের হয়ে মুসল্লিদের কাছে আগেভাগেই ভোট চেয়ে রাখছেন তারা।’
প্রতিপক্ষ জামায়াতের যখন রণ প্রস্তুতি, তখন আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য বিএনপির প্রস্তুতি কতটা? ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চাইলেও আসলেই বিএনপি কি প্রস্তুত নির্বাচনের জন্য? বেশ কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি সংসদীয় আসনেই বিএনপির একাধিক প্রার্থী কাজ করছেন নির্বাচন সামনে রেখে। কোথাও কোথাও বড় বড় বিলবোর্ডে নিজেদের ছবি লাগিয়ে এমপি হিসেবে দেখতে চাই লেখা। সম্ভাব্য কয়েকজন এমপি-প্রত্যাশির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখনো প্রার্থীদের সুনির্দিষ্টভাবে গ্রিন সিগন্যাল না দেওয়ায় অনেক আসনে তিন-চারজন করে কাজ করছেন। এ ছাড়া অধিকাংশ আসনে রয়েছে দলীয় কোন্দল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েস্বর চন্দ্র রায় রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘জামায়াত প্রার্থী চূড়ান্ত করলেও বিএনপির প্রার্থীর সংকট নেই। কোনো কোনো আসনে আমাদের ১০ জন প্রার্থী আছে।’ এত প্রার্থী যেসব আসনে থাকে, সেসব আসনে দলীয় কোন্দল প্রকট হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বড় দলে প্রার্থী বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কোন্দল হবে কেন? দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তারা লড়বেন নির্বাচনি মাঠে, বাকিরা তার পক্ষে কাজ করবেন। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিরোধিতা করলে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।’
এদিকে গত সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জনসম্পৃক্ত নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে ভোটারদের ‘ডোর টু ডোর’ যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আর এ কাজে পুরুষের পাশাপাশি ব্যাপক পরিসরে দলের মহিলা নেতাকর্মীদেরও সম্পৃক্ত করা হবে। কেন আগামী ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন প্রয়োজন; নির্বাচন বিলম্বিত হলে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগও পিছিয়ে যাবে, যে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য তারা দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর লড়াই-সংগ্রাম করেছেÑ বিএনপির পক্ষ থেকে এ বিষয়গুলো জনগণের কাছে তুলে ধরা হবে। একই সঙ্গে বিএনপি ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফার প্রচারণা এবং আগামী দিনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে এই ৩১ দফার ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, সেই প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হবে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জনগণকে নির্বাচনমুখী করার পাশাপাশি দলকেও পুরোপুরি নির্বাচনমুখী করতে চায় বিএনপি। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কীভাবে নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা যায়, সে ব্যাপারে বিএনপির নেতারা আলোচনা করেন।
তারা বলেন, আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে আর পাঁচ মাসের মতো বাকি রয়েছে। এমন অবস্থায় দলকে পুরো নির্বাচনমুখী করতে হবে, প্রস্তুত করতে হবে। এ লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করতে চায় দলটি। বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া এমন সংস্কার প্রস্তাবগুলো নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন করার পক্ষে বিএনপি।
এদিকে তপশিলের আগে একক প্রার্থী চূড়ান্তের বিষয়টি বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা স্বীকার করেছেন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। এ জন্য দলের সিদ্ধান্তেও পরিবর্তন আসবে। নানা হিসাব-নিকাষ শেষেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এবার আগেই আসনভিত্তিক একক প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। একক প্রার্থীর নেতৃত্বে দলীয় অবস্থান সুসংহত করা এবং জনগণের আরও কাছে পৌঁছানোর চেষ্টার অংশ হিসেবেই এটি করার পরিকল্পনা হচ্ছে।
এর কারণ হিসেবে নেতারা জানান, তপশিলের পর একক প্রার্থী ঘোষণা করলে আসনভিত্তিক নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ ২০১৪ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করা হয়েছিল। আবার ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়। তাই বলাই যায়, দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাচন থেকে দূরে থাকা এবং আওয়ামী লীগের নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে ভোটকেন্দ্রিক দৌড়ঝাঁপ হয়নি, যে কারণে এবার প্রতিটি আসনে বিএনপির বহু প্রার্থী নির্বাচন করার জন্য মনোনয়ন চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে ভোটের আগমুহূর্তে নানা দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং সৃষ্টির আশঙ্কা থাকবে, যার প্রভাব দল ও ভোটের মাঠে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই ধারণা থেকেই মূলত তপশিলের আগেই বেশির ভাগ আসনে একক প্রার্থী ঘোষণার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে আসনভিত্তিক যারা মনোনয়নপ্রত্যাশী, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে একক প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবেনÑ এমন প্রত্যাশা নীতিনির্ধারকদের।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের আরও অভিমত, আপাতত ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ আসনে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করে ঘোষণা হতে পারে। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত তরুণদের বেশি সুযোগ দিতে চাইছে দলটির হাইকমান্ড। বাকি আসনে ‘জোট’ কিংবা ‘সমঝোতার’ বিষয়টি মাথায় রেখেই হয়তো ঘোষণা করা হবে না। আবার মিত্রদেরও কয়েকটি আসনের নিশ্চয়তা দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার কথা মৌখিকভাবে জানানোও হতে পারে। তবে তপশিল ঘোষণার পরই ‘জোট’ কিংবা ‘সমাঝোতা’ যা-ই হোক না কেন, তাদের আসন ছাড় দেওয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হবে।
বিএনপি গঠনতন্ত্রের ১৪ অনুচ্ছেদ মতে, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য কিংবা অন্য যেকোনো নির্বাচনের জন্য দলের প্রার্থী মনোনয়নে দলের একটি পর্লামেন্টারি বোর্ড থাকবে। জাতীয় স্থায়ী কমিটিই হবে দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড। নির্বাচনে দলের প্রার্থী মনোনয়নের দায়িত্ব পার্লামেন্টারি বোর্ড পালন করবে এবং এ ব্যাপারে বোর্ডের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।’ বিএনপি সূত্র বলছে, দ্রুততম সময়ে দেশে ফিরবেন তারেক রহমান এবং তিনিই চূড়ান্ত করবেন আগামী নির্বাচনের প্রার্থী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এবার প্রার্থী মনোনয়নে বড় ধরনের অনেক চমক থাকতে পারে। কিছু আসনে এমন ব্যক্তিদের প্রার্থী দেওয়া হবে, যাদের কথা অনেকের চিন্তার মধ্যেও থাকবে না। আবার অনেক সিনিয়র ও প্রভাবশালী নেতাও শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন টিকিট পাবেন না। এতটুকু বলা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ত্যাগী, সৎ-যোগ্য, সর্বোপরি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকেই বেছে নিতে পারেন। এ ছাড়া এটা নিশ্চিত যে, যার বিরুদ্ধে অপকর্মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে এবং মাঠে গ্রহণযোগ্যতা নেই, তিনি প্রার্থী হতে পারবেন না। এ বিষয়ে অনেক আগে থেকেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের আমলনামা রয়েছে। তবে ফ্যাসিবাদি সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যুগপৎ আন্দোলনে যারা সঙ্গে ছিলেন, তাদেরই এই নির্বাচনে মূল্যায়ন করার পরিকল্পনাও রয়েছে।