ঢাকা রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ডেঙ্গুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চিকুনগুনিয়া

স্বপ্না চক্রবর্তী
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৫, ১১:২৬ পিএম
  • হাসপাতালে হাসপাতালে রোগীদের ভিড়ে বাড়ছে হাহাকার
  • ডেঙ্গু আক্রান্তের রেকর্ড করা হলেও চিকুনগুনিয়ার হিসাব নেই
  • চিকিৎসাসেবায় সরকারের পক্ষ থেকে নেই কোনো গাইড লাইন
  • সতর্কতার বিকল্প নেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা

এ যেন ২০১৯ সালের পুনরাবৃত্তি। একদিকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখি অন্যদিকে করোনার সূচনা। বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনা যখন তা-ব চালাচ্ছিল। তখনো বাংলাদেশ এর ভয়াবহতা বুঝতে পারেনি। ২০২০ সালের মার্চ নাগাদ হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করে সবাই। লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন আর আইসোলেশনের মতো কঠিন ও নতুন শব্দ ও পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচয় হয় অনেকের। ঠিক ছয় বছর পর আবারও যেন একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে দেশ। তবে এবার করোনা নয় ডেঙ্গুর পাশাপাশি আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চিকুনগুনিয়া। মশার কামড়ে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন রোগীরা। সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিতভাবে রেকর্ড করলেও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের নেই কোনো পরিসংখ্যান। ফলে এই রোগে দেশে ঠিক কতজন ভুগছেনÑ জানে না কেউ। তবে রোগটি যে শুধু বাংলাদেশে আতংক জাগিয়েছে এমন নয়; সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এ বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১৮ হাজার ৯৭ জন। মৃত্যুবরণ করেন ৮৭ জন। গতকাল শনিবার পর্যন্তই আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ১৫ হাজার ৪৪২ জনে। প্রাণ হারিয়েছেন ৭০ জন। বছরের শুরু থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃত্যু হয় ১৮৮ জনের। মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ২০৬। তবে চিকুনগুনিয়ার কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও হাসপাতালে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন্ন আক্রান্ত রোগীরা।

রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত পারভেজ আহমেদ বলেন, প্রথমে জ¦র আসার পর মনে করি ডেঙ্গু। কিন্তু শরীরে তীব্র ব্যথা যখন সহ্য করতে পারছিলাম না তখন হাসপাতালে আসলে পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান আমি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। শরীরে এত অসহনীয় ব্যথা আর সহ্য করতে পারছি না। মনে হয় যেন দুঃস্বপ্ন দেখছি জেগে জেগে।

একইরকমভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে তীব্র ব্যথায় কাতরাচ্ছেন মুগদার বাসিন্দা তানভীর রহমান। ডেঙ্গু মনে করে হাসপাতালে ভর্তি হলেও পরে চিকিৎসকরা জানান এটি চিকুনগুনিয়া। সারা শরীরের ব্যথায় মাথা কাজ করছে না বলে জানান তিনি।

ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছে জানিয়ে ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. সালেহ মাহমুদ তুষার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আগে শুধু ডেঙ্গু রোগী পেলেও বর্তমানে প্রতিদিনই চিকুনগুনিয়ার রোগীও পাচ্ছি। যারা শরীরে তীব্র ব্যথা নিয়ে আসছেন হাসপাতালে। অনেকে ব্যথার কারণে হেলুসিলেশনেও ভুগছেন। এ ব্যাপারে চিকিৎসার সুনির্দিষ্ট কোনো গাইড লাইন না থাকলেও আমরা যথাসম্ভব রোগীর কষ্ট কমানোর চেষ্টা করছি। 

একই রকম অবস্থা মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরও। হাসপাতালটি ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় বেশ সুনাম অর্জন করলেও সম্প্রতি চিকুনগুনিয়ার রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে জানিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মেজবাউর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, শরীরে তীব্র ব্যথা নিয়ে রোগীরা আসছেন। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে যেহেতু এর চিকিৎসায় আলাদা কোনো গাইড লাইন নেই তাই বেশিকিছু করার সুযোগ নেই। 

তবে একেবারেই নাজুক অবস্থা রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। পুরান ঢাকার একমাত্র ভরসাস্থল এ হাসপাতালে রোগীর চাপ এত বেশি থাকেÑ কোনটা করোনা বা কোনটা ডেঙ্গু বা কোনো ইনফ্লুয়েঞ্জা তা বোঝা মুশকিল। এমনটা জানিয়ে রাজধানী শনির আখড়া থেকে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা সিফাত রহমান বলেন, এসেছিলাম জ¦র নিয়ে। প্রথমে ডেঙ্গু পরীক্ষা করেছেন ডাক্তাররা। নেগেটিভ এসেছে। এখন চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করানোর কথাও বলেন তারা।

জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালেও। হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদাভাবে কর্নার থাকলেও চিকুনগুনিয়া রোগীদের জন্য নেই কোনো বিশেষ ব্যবস্থা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালটির একজন চিকিৎসক বলেন, দেশব্যাপী যখন করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ ছিল তখনও আমরা সর্বোচ্চ সেবা দিয়েছি। ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া রোগীদেরও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে চিকুনগুনিয়া নিয়ে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন জরুরি।

এদিকে রোগটির বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিকুনগুনিয়ার কারণে বাংলাদেশকে ভ্রমণকারীদের স্বাস্থ্য সতর্কতার দ্বিতীয় স্তরে অন্তর্ভুক্ত করেছে। 

দ্বিতীয় স্তরের সতর্কতায় যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বলছে, বাংলাদেশ, কেনিয়া, মাদাগাস্কার, সোমালিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব রয়েছে। মশা চিকুনগুনিয়া সৃষ্টিকারী ভাইরাস ছড়ায়। মশার কামড় রোধ করে আপনি নিজেকে যেভাবে রক্ষা করতে পারেন, তার মধ্যে আছে পোকামাকড় প্রতিরোধক ব্যবহার করা, লম্বা হাতার শার্ট এবং লম্বা প্যান্ট পরা, এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা জানালা এবং দরজায় পর্দা রয়েছে এমন জায়গায় থাকা। সিডিসি আরও জানায়, চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের আছে এমন কোনো অঞ্চল পরিদর্শন করছেন এমন ভ্রমণকারীদের জন্য টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেয় সিডিসি।

আপনি যদি অন্তঃসত্ত্বা হন, তবে আক্রান্ত অঞ্চলে ভ্রমণ পুনর্বিবেচনা করুন। বিশেষ করে যদি আপনি আপনার সন্তান প্রসবের কাছাকাছি অবস্থায় থাকেন। প্রসবের সময় সংক্রমিত মায়েরা প্রসবের আগে বা প্রসবের সময় তাদের শিশুর মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ করতে পারেন। এভাবে বা মশার কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত নবজাতকদের দীর্ঘমেয়াদি জটিলতাসহ গুরুতর অসুস্থতার ঝুঁকিতে থাকে। সিডিসির সতর্কবার্তায় বলা হয়, ভ্রমণের সময় বা পরে যদি আপনার জ্বর, জয়েন্টে ব্যথা, মাথাব্যথা, পেশি ব্যথা, জয়েন্টে ফোলাভাব বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

তবে দেশের সব বড় হাসপাতালেই পরীক্ষা এবং চিকিৎসার পর্যাপ্ত নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকার প্রায় সব বড় হাসপাতালের পাশাপাশি রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, কুমিল্লা, রংপুরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো পরীক্ষা কিট পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসকদের বলা হয়েছে রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে।’ ডেঙ্গুর রেকর্ড নিয়মিতভাবে সংগ্রহ করা হলেও চিকুনগুনিয়া নিয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন কেন তৈরি হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি।’ 

তবে পরিস্থিতি যাই হোক মশাবাহিত রোগটি থেকে বাঁচতে মশার কামড়ের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার বিকল্প নেই জানিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখন ঢাকায় ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা। এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক হওয়ায় মানুষ অতি সতর্ক থাকেন।

কিন্তু কিউলেক্সের ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। দেশের ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ মশার এই প্রজাতি ফাইলেরিয়া বা গোদরোগের জীবাণু বহন করে। এ ছাড়াও কিউলেক্স মশার কামড়ে চর্মরোগও হয়ে থাকে। বেশি উপদ্রবের সময় স্বস্তিতে কোনো কাজ করতে পারে না মানুষ। নগরবাসীকে রোগ-ব্যাধি ও অস্বস্তি থেকে পরিত্রাণ দিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। মশা নিধনে সরকার যতই ব্যবস্থা গ্রহণ করুক না কেন তা যে ব্যর্থ সেটা আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তাই জনসাধারণের সচেতনতার বিকল্প নেই।