ঢাকা বুধবার, ০১ অক্টোবর, ২০২৫

জুলাই সনদ নিয়ে ঐক্যের চেষ্টায় নিউইয়র্কে বৈঠক!

হাসান আরিফ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৫, ১১:২৯ পিএম
  • নিউইয়র্ক সফরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক
  • জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্যের লক্ষ্যে বৈঠক। চেষ্টা ছিল রাজনৈতিক সমঝোতা ও নির্বাচনি লক্ষ্য অর্জন
  • জুলাই গণহত্যার বিচার এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার আদায়ও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য 

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফরে গিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সফরসঙ্গী তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বহুল আলোচিত ‘জুলাই সনদ’। যা দেশের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণের মূল দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত এই দলিলের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতা ও নির্বাচনি লক্ষ্য অর্জন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এ ছাড়া জুলাই যোদ্ধাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যতে যাতে জুলাই অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা। একাধিক সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং নতুন রাজনৈতিক শক্তি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষ নেতারা। আলোচনার মূল লক্ষ্যই জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে ঐকমত্য সৃষ্টি করা এবং নির্বাচিত সরকার গঠনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার আদায় করা।

নির্বাচনি কাঠামো নিয়ে দলগুলোর ভিন্ন অবস্থান

সূত্রমতে, নিউইয়কের্র আলোচনায় বিএনপি স্পষ্ট জানিয়েছে, তারা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) ভিত্তিক নির্বাচন চায় না। বিএনপি নেতাদের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বাস্তবতায় পিআর ব্যবস্থা অচল এবং এতে রাজনৈতিক দলগুলোর আসল শক্তি বিকৃত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাদের মতে, জনগণের সরাসরি ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতেই সরকার গঠন করতে হবে।

অন্যদিকে, এনসিপি চাইছে নির্বাচনি ব্যবস্থায় উচ্চকক্ষ (সিনেট জাতীয় কাঠামোর মতো) যুক্ত হোক। তাদের যুক্তি, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও মেরূকরণের ফলে নীতি নির্ধারণে ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি উচ্চকক্ষ অপরিহার্য। সংসদের পাশাপাশি একটি দ্বিতীয় কক্ষ থাকলে ছোট দলগুলোর মতামত ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে বলে তাদের দাবি।

এ ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী চাইছে, উচ্চকক্ষ ও নি¤œকক্ষÑ দুই কাঠামোতেই তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক। তারা মনে করছে, জাতীয় রাজনীতিতে স্থায়ী ভূমিকা রাখতে চাইলে উভয় কক্ষের প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন।

এই বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তিনটি দলই মোটামুটি নির্বাচনে যেতে সম্মত হয়েছে। ফলে পিআরের জন্য আর নির্বাচনে কোনো সমস্যা হবে না। আইনশৃঙ্খলাও ঠিক হয়ে যাবে। তা ছাড়া নি¤œকক্ষে পিআর হবেও না। আর উচ্চকক্ষ বলে তো দেশে কিছু নেই। ফলে এ নিয়ে বির্তক বাড়িয়েও কোনো লাভ নেই।

অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা ও বৈধতার প্রশ্ন

সমঝোতা বৈঠকে আরেকটি বড় আলোচ্য বিষয় ছিল, নির্বাচিত সরকার গঠনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা ও তাদের নিরাপত্তা। প্রধান উপদেষ্টা চান, নির্বাচিত সরকার যেন একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেয়Ñ অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সদস্যকে পরবর্তী সময়ে প্রতিশোধমূলক মামলা, হয়রানি বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মুখে ফেলা হবে না।

বিএনপি ও জামায়াত এ বিষয়ে মৌখিকভাবে আশ্বাস দিলেও এখনো লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়নি। অন্যদিকে, এনসিপি জানায় তারা এমন প্রতিশ্রুতিতে রাজি। ফলে এই আলোচনায় আংশিক অগ্রগতি হলেও পূর্ণ নিশ্চয়তা এখনো মেলেনি।

ঐকমত্যের পথে কতটা সম্ভাবনা?

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ঘনিষ্ঠ মহল জানায়, বৈঠক ছিল খোলামেলা ও ফলপ্রসূ। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছাতে আরও কয়েক দফা আলোচনা প্রয়োজন হবে। জুলাই সনদ নিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নিজেদের অবস্থানে নমনীয়তা না আনছে, ততক্ষণ পর্যন্ত একটি যৌথ ঘোষণা আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছেÑ কোন পথে এগোবে জুলাই সনদ? তা কি কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দরকষাকষির দলিল হয়েই থাকবে, নাকি এটি সত্যিই একটি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তি হয়ে উঠবে। এই উত্তরই খুঁজছে দেশ।

নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সমঝোতাই লক্ষ্য

সূত্র মতে, পুরো আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলোÑ আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সমঝোতা নিশ্চিত করা। নির্বাচনি কাঠামো, সংসদীয় ব্যবস্থা কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তাÑ সবকিছু নিয়েই শেষ পর্যন্ত দরকষাকষির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো চায় তাদের অস্তিত্ব, ক্ষমতার ভাগ এবং ভবিষ্যৎ অবস্থান সুরক্ষিত করতে। ফলে জুলাই সনদকে ঘিরে ঐকমত্যের যে প্রচেষ্টা চলছে, তা সরাসরি নির্বাচনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

কোথায় আটকে যাচ্ছে জুলাই সনদ?

মূলত রাজনৈতিক নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানই জুলাই সনদকে কার্যকর করতে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিএনপি যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একক নি¤œকক্ষের নির্বাচনেই সন্তুষ্ট, সেখানে এনসিপি উচ্চকক্ষের দাবি তুলছে, আর জামায়াত চাইছে উভয় কাঠামোতে জায়গা করে নিতে। এর ফলে সনদে একটি সুস্পষ্ট কাঠামো নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই সনদের উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামো ও নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর একটি যৌথ নীতি-ঘোষণা তৈরি করা। কিন্তু বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিÑ তিন পক্ষের ভিন্নতর অবস্থান এই দললিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, জুলাই সনদ একটি রূপকল্প। কিন্তু বিএনপি যেহেতু অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মানতে নারাজ আর এনসিপি ও জামায়াত উচ্চকক্ষের দাবি ছাড়তে রাজি নয়Ñ তাহলে এ ক্ষেত্রে মীমাংসা না হলে পুরো প্রক্রিয়া থমকে যেতে পারে।
ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি বক্তব্য

বহুল আলোচিত জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন নানামুখী বিতর্ক ও দরকষাকষি চলছে, তখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রিয়াজ জানিয়েছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যেই এই সনদ চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, কিছু মৌলিক ইস্যুতে এখনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা হয়নি, বিশেষ করে সংসদের উচ্চকক্ষ বা সিনেটধর্মী কাঠামো গঠনের প্রশ্নে আলোচনা আরও সময় নিতে পারে।

ড. আলী রিয়াজ বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামীর পথরেখা তৈরি হবে। এটি কেবল একটি দলিল নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামোর দিকনির্দেশনা। অনেক বিষয়ে ইতোমধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, তবে কয়েকটি জায়গায় এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

তিনি জানান, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের ভিন্ন অবস্থান সত্ত্বেও কমিশন চেষ্টা করছে ন্যূনতম ঐকমত্যে পৌঁছাতে। এনসিপি ও জামায়াত যেখানে উচ্চকক্ষের দাবি তুলছে, সেখানে বিএনপি এখনো সরল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতেই সংসদ চালু রাখতে চাইছে। এই বিরোধিতার কারণেই সনদের কাঠামো নির্ধারণে বিলম্ব হচ্ছে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন। তিনি আশা করছেন আগামী কয়েক দিনের মধ্যে উচ্চকক্ষের ব্যাপারে একটি প্রাথমিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে। তারপর পুরো সনদ একত্রে প্রকাশ করা হবে।

জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি জোর দিয়ে বলেন, সনদটি একবার চূড়ান্ত হলে তা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি রূপরেখা নয়, বরং নির্বাচনের পরবর্তী ক্ষমতা হস্তান্তর ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা প্রশ্নেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে দাঁড়াবে।