আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের পদ্ধতি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনের বাকি চার মাসের কিছু বেশি সময়। এ অবস্থায় জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতি ঘিরে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে রয়েছে শক্ত অবস্থানে। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্য না হওয়ায়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন এরই মধ্যে অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন, পিআর পদ্ধতি সংবিধানে নেই, আরপিওতে (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) পিআর নেই। ফলে আরপিও সামনে রেখেই কমিশনকে এগোতে হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, নি¤œকক্ষে পিআর পদ্ধতি আগামী নির্বাচনে সম্ভব নয়। ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতেই হচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচন। এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী স্থানীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির বিষয়ে এখনো অটল রয়েছে। তবে এনসিপিসহ অনেক দলই নি¤œকক্ষ নয় বরং উচ্চকক্ষে চাইছে পিআর পদ্ধতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. স ম আলী রেজা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন যা বলেছেন, এটিই বাস্তবতা। তিনি যেমনটা বলেছেন, বিদ্যমান কাঠামোতে পিআর পদ্ধতিতে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে এরপর নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তন সম্ভব নয় এমনটিও নয়। রাজনৈতিক সব স্টেক হোল্ডার যদি ঐকমত্যে আসতে পারেন, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব। সুতরাং, পিআরে যেতে হলে অবশ্যই বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন।’
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হতে যাচ্ছেÑ এমন প্রশ্নে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. রইস উদ্দীন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জাতীয় নির্বাচন হতে হবে নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে। সেই কাঠামো হচ্ছে সংবিধান ও আরপিও। ফলে, পিআর পদ্ধতি নয়, প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতেই হবে জাতীয় নির্বাচনÑ এটি স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। জুলাই অভুত্থানের পর একটি ঐকমত্য গঠিত হয়েছে, যে ঐকমত্য কমিশনে উচ্চকক্ষে পিআরের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং তার সপক্ষে বেশ কিছু দল মতামতও দিয়েছে। তবে নি¤œকক্ষে পিআর হতে হবে এমন মতামত বা ফলপ্রসূ আলোচনা দেখা যায়নি। ফলে নি¤œকক্ষে পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা বা প্রসঙ্গ উপস্থাপন এখন যৌক্তিক বা প্রাসঙ্গিক নয়। একই সঙ্গে, পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশে জনগণের জন্যও পুরোপুরি নতুন। ফলে এটি এখনই ব্যবহারের উপযোগীও নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ প্রেক্ষাপটে গঠিত সরকার, যাদের মূল কাজই ছিল মানুষের ম্যান্ডেটকে মূল্যায়ন করে জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। নেপালের দিকে যদি তাকান, সেখানে মাত্র তিন মাসের মধ্যেই কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে, বাংলাদেশে নতুন পেক্ষাপটে যৌক্তিক সংস্কার যতটুকু হয়েছে, সে বিষয়ে সবাই একাত্ম থেকে আগামীতে সুন্দর একটা নির্বাচন আয়োজন করা উচিত।’
এদিকে পিআর ইস্যুতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ঝুলন্ত পার্লামেন্টের জন্ম দেবে। বাংলাদেশের মানুষ এই পদ্ধতির বিপক্ষে। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টির জন্য কেউ কেউ নানা ইস্যু তুলে ষড়যন্ত্র করছে এবং সেটা দৃশ্যমান।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ এখন নির্বাচনমুখী, বাংলাদেশে এখন নির্বাচনের আমেজ চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনসংযোগে ব্যস্ত। এ অবস্থায় কোনো দল যদি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি করে, জনগণ তাদের চিহ্নিত করবে এবং রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রত্যাখ্যান করারও সম্ভাবনা আছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের এই যে নির্বাচনের প্রক্রিয়া, তাতে বাধা সৃষ্টির জন্য কেউ কেউ ষড়যন্ত্র করছে সেটা দৃশ্যমান। এখানে আন্তর্জাতিক মহলও থাকতে পারে; দেশি-বিদেশি শক্তি সক্রিয়, সেটা আমরা অনুমান করতে পারি। তবে, দেশের জনগণ এখন ঐক্যবদ্ধ। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ সংকল্পবদ্ধ।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পিআর পদ্ধতি আমাদের সংবিধানে নেই। এই পদ্ধতি আরপিওতেও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) নেই। ফলে দেশের প্রচলিত যে পদ্ধতি আছে, সেই পদ্ধতিতেই আগামী নির্বাচন হবে। পিআর নিয়ে কয়েকটি দল যে আলোচনা করছে, এটি রাজনৈতিক স্ট্যান্ড ছাড়া কিছুই নয়। কোনো বিশেষ মহল মনে করতে পারে, নির্বাচন হলে তাদের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন না বা ভবিষ্যৎ নেই। এ জন্যই তারা মুখরোচক কথাবার্তা বলছেন।’
এদিকে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে বিশ্বে চালু থাকা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে পিআর পদ্ধতি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ। আগামী নির্বাচন দেশের জনগণ পিআর পদ্ধতিতে চাইছে।’ তিনি বলেন, ‘পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে পেশিশক্তি, কালোটাকার প্রভাব ও মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হবে এবং প্রতিটি ভোটের যথাযথ মূল্যায়ন হবে। রাষ্ট্রপতির ভোটের মতোই একজন রিকশাওয়ালার ভোটেরও মূল্যায়ন থাকবে। এই পদ্ধতিতে মানসম্পন্ন সংসদ গঠিত হবে। বিগত দিনে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনি সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য পিআর পদ্ধতিও প্রতিষ্ঠিত হবে। বর্তমানে বিশ্বের ৯১টি দেশে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে।’
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। জামায়াতে ইসলামী স্বপ্ন দেখে না; জনগণই জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কারণ জনগণ বিশ্বাস করে, জামায়াতে ইসলামীতে দুর্নীতি নাই, সন্ত্রাস নাই, চাঁদাবাজ নাই।’
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দেশে সকাল-বিকাল এমপি বেচাকেনা হবে এবং সরকারের স্থিতিশীলতা থাকবে না। স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে বর্তমান পদ্ধতিতেই নির্বাচন করতে হবে। নি¤œকক্ষে (জাতীয় সংসদ) পিআর বাংলাদেশের বাস্তবতায় কখনোই সম্ভব নয়, তবে উচ্চকক্ষে পিআর নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।’
এদিকে, পিআর পদ্ধতির দাবির বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, নি¤œকক্ষে পিআর পদ্ধতি চায় না এনসিপি। তাদের অবস্থান নি¤œকক্ষে পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি ও জবাবদিহির জন্য একটা কার্যকর উচ্চকক্ষ চাইছি। সেটাকে নিশ্চিত করেই যেন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা হয়।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি ইস্যুতে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে অনৈক্য স্পষ্ট। তবে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে ঐক্য দৃশ্যমান। সেখানে, পিআর ও জুলাই সনদ; মোটা দাগে এ দুটি ইস্যুতে বাইরে মতবিরোধ থাকলেও বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার, এবি পার্টি, চরমোনাই পিরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট দলগুলোতে জোর গতিতে চলছে ভোটের প্রস্তুতি।