ঢাকা মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর, ২০২৫

গণভোটে জুলাই সনদের গ্যারান্টি!

হাসান আরিফ
প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২৫, ১০:৫৯ পিএম

সময়ের আলোচিত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে যে ঐকমত্য গড়ে উঠেছে, তা দেশের রাজনীতিতে নতুন এক বিতর্ক ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, জনগণের অংশগ্রহণ ও সম্মতি নিশ্চিত করার জন্য গণভোট অনুষ্ঠানে সব রাজনৈতিক দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে এই গণভোটের সিদ্ধান্ত ও ফল ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকার মানবে কি নাÑ তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। কবে হবে গণভোট, জাতীয় নির্বাচনের দিন নাকি আসছে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে? এই গণভোট কি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে পারবে?Ñ এমন নানা প্রশ্ন তুলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাল বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকে গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে চায়। কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, যদি ঐকমত্য না হয় তবে একাধিক বিকল্প প্রস্তাব আনা হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, এবার গণভোট নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হলে জনগণ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ পাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব মিলিয়ে বলা যায়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট শুধু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সাংবিধানিক সংস্কৃতি এবং জনআকাক্সক্ষার পরীক্ষামূলক ধাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাসে গণভোটকে কেন্দ্র করে যত বিতর্ক থাকুক না কেন, এবারকার গণভোট দেশের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এখন দেখার বিষয়Ñ দলগুলোর ঐকমত্য ও জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাওয়া এই ম্যান্ডেট নির্বাচিত সরকার কতটা আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করে, নাকি আগের মতো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গণভোট হলে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটা বাধ্যবাধকতা চলে আসবে। যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছু না মানাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। তারপরও জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে গণভোট যেহেতু সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিতেই হবে, তাই মুখ রক্ষা করার জন্য হলেও নির্বাচিত সরকার তা মেনে চলবে।

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, দলগুলোর মধ্যে একটা ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এখন গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে না এক সাথে হবে, তা নির্ধারণ করতে হবে। তবে তার ধারণা, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগেই হবে। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সাথে গণভোট হলে তা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।

দলগুলোর অবস্থান

বিএনপি মনে করছে, জাতীয় নির্বাচনের দিন একইসঙ্গে গণভোট আয়োজন করলে সংবিধান সংশোধনের দরকার হবে না এবং জনগণের স্পষ্ট ম্যান্ডেট পাওয়া যাবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যাতে ম্যান্ডেটের অভাব না হয়, জনগণ এটা সমর্থন করে কি না, তা অনুমোদনের জন্য একই দিনে গণভোট করা জরুরি।

জামায়াতে ইসলামী বলছে, সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হওয়া উচিত। তাদের যুক্তি, এতে জুলাই সনদের শক্তিশালী আইনি ভিত্তি তৈরি হবে। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আগে গণভোট হয়ে যাক, তারপর নির্বাচন হোক। এতে বিতর্ক কমবে এবং জনগণের অনুমোদন স্পষ্ট হবে।

নবগঠিত এনসিপি আবার ভিন্ন মত দিয়েছে। তারা মনে করছে, গণভোটের আগে জুলাই সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। তাদের যুক্তি, শুধু গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সমর্থন পেলেও আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলে ভবিষ্যতের সরকার তা উপেক্ষা করতে পারে। তবে তারাও জাতীয় নির্বাচনের দিন একইসঙ্গে গণভোটের পক্ষে।

নির্বাচিত সরকার মানবে কি না

এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচিত সরকার এই গণভোটের রায় মানতে বাধ্য হবে কি না। বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামো অনুযায়ী গণভোটের ফল আইনি বাধ্যতামূলক হবে কি না, তা এখনো অস্পষ্ট। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান তুলে দেওয়া হয়েছিল। তবে ৫ আগস্টের পর আদালত গণভোট পুনর্বহালের রায় দিয়েছে। কিন্তু সেই রায় কার্যকর করার সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া এখনো নির্ধারণ হয়নি।

সংসদবিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, যদি নির্বাচিত সরকার মনে করে যে, গণভোট কেবল রাজনৈতিক চাপ তৈরি করার একটি কৌশল, তাহলে তারা এটি উপেক্ষা করতে পারে। তবে বিপুল জনমত থাকলে সরকারকে তা মানতে বাধ্য হতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরাপত্তা প্রস্তাব

রাজনৈতিক দলগুলোর আরেকটি মূল চিন্তা হলোÑ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অনেক দল আশঙ্কা করছে, নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন দল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গড়িমসি করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তাই তারা গণভোটের মাধ্যমে এমন একটি জনমত গড়ে তুলতে চাইছে, যা ভবিষ্যতের সরকার অগ্রাহ্য করতে না পারে।

একইসঙ্গে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচিত সরকার যদি জনগণের ম্যান্ডেট থাকা সত্ত্বেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়, তবে তা দেশে নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করবে। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ুম বলেন, গণভোটকে যদি অবহেলা করা হয়, তবে তা জনগণের প্রত্যাশা ভঙ্গ করবে এবং আবারও রাজনৈতিক আস্থাহীনতা তৈরি করবে।

গণভোটের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত তিনটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পক্ষে ৯৮ দশমিক ৮০ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট আসে, আর ১৯৮৫ সালে এরশাদের পক্ষে পাওয়া যায় ৯৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, উভয় ক্ষেত্রেই জনগণ প্রকৃত অর্থে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি, বরং প্রশাসন ও সেনাবাহিনী ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরেছিল।

সংসদীয় ইতিহাসবিদ নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, প্রথম দুটি গণভোটই ছিল সামরিক শাসকদের বৈধতা নিশ্চিত করার আয়োজন, জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ সেখানে ছিল না।

তৃতীয় গণভোট হয় ১৯৯১ সালে, দ্বাদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে দেশ সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসে। তবে এ গণভোটও খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি, কারণ তখনকার সব রাজনৈতিক দল আগেই সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষে একমত হয়েছিল। যদিও ভোটের ফলে ৮৪ শতাংশের বেশি ভোট পড়ার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু সে সময়ও কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল।

আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুমের মতে, ১৯৯১ সালের গণভোট কার্যত আনুষ্ঠানিকতাই ছিল। কারণ সিদ্ধান্ত দলগুলো আগেই নিয়ে ফেলেছিল। তাই এটি জনমতের প্রতিফলন হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।

নতুন গণভোটকে ঘিরে আশা ও সংশয়

এবারের গণভোটের বিষয়বস্তু জুলাই সনদÑ যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের একটি ঘোষণাপত্র হিসেবে সামনে এসেছে। সরকার থেকে শুরু করে প্রধান বিরোধী দল ও নবগঠিত দলগুলো এই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় গিয়ে গণভোটে পাওয়া ম্যান্ডেট মানবে কি না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের অভিজ্ঞতা থেকে জনগণের মধ্যে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। কারণ, ইতিহাসে দেখা গেছে নির্বাচিত সরকার বা সামরিক সরকার উভয় সময়েই গণভোটকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এবার যদি জনগণ বিপুলভাবে জুলাই সনদের পক্ষে ভোট দেয়, তাহলে নির্বাচিত সরকার সেটি মানতে বাধ্য থাকবে কি না, নাকি রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুযায়ী উপেক্ষা করবেÑ তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, এবারের গণভোট আলাদা। কারণ এটি কোনো ব্যক্তি বা সামরিক শাসকের বৈধতা দেওয়ার জন্য নয়, বরং একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সনদ বাস্তবায়নের জন্য। তাই এর গুরুত্ব আগের সব গণভোট থেকে অনেক বেশি।