ঢাকা বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

শাপলা প্রতীক নিয়ে মুখোমুখি

ইসির স্পষ্ট বার্তা ‘না’, তবু অনড় এনসিপি

স্বপ্না চক্রবর্তী
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৫, ১২:০৬ এএম

শেখ হাসিনা সরকার পতনে নেতৃত্বদানকারীরা জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নামের রাজনৈতিক দল গঠন করে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়ার সব যোগ্যতা অর্জন করেছে দলটি। প্রতীক চূড়ান্ত হলে দলটিকে নিবন্ধন সনদ দেওয়া হবে। কিন্তু প্রতীক ইস্যুতেই দুটি ভিন্ন অবস্থানে অনড় এনসিপি ও নির্বাচন কমিশন। নিজেদের পছন্দের প্রতীক হিসেবে শাপলা পেতে মরিয়া দলটি। কিন্তু ইসির তালিকায় না থাকার কারণে কোনোভাবেই এটি দেওয়া যাবে না বলে স্পষ্ট জানিয়েছে ইসি। প্রয়োজনে ইসি নিজ উদ্যোগেও প্রতীক দেওয়ার কথা বলছে। যা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন এনসিপির নেতারা। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা দলটির প্রতীক নিয়ে তৈরি হওয়া এ বিড়ম্বনা আসন্ন নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

আগামী রোববারের মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা বিধির তপশিলে থাকা নির্ধারিত তালিকা থেকে দলের প্রতীক বাছাই করে জানাতে ব্যর্থ হলে ‘স্বীয় পদ্ধতিতে’ এনসিপিকে মার্কা দেওয়া হবে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এনসিপিসহ দুটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। দল দুটির প্রতীকসহ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর দলটিকে তপশিলে থাকা ৫০টি প্রতীক থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত পছন্দ জানানোর জন্য চিঠি দেয় ইসি। নির্ধারিত সময়ে এনসিপি পছন্দের প্রতীক বাছাই না করে বিধি সংশোধন করে ফের শাপলা বরাদ্দের দাবি জানায়। কিন্তু ইসি কাউকে শাপলা প্রতীক না দেওয়ার বিষয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, এনসিপিকে শাপলা দেওয়ার সুযোগ নেই। ১৯ অক্টোবরের মধ্যে এনসিপিকে শাপলার বিকল্প প্রতীক নিতে হবে এবং আমাদের জানাবে; না হলে ইসি নিজ উদ্যোগে অন্য প্রতীক দিয়ে নিবন্ধন দেবে। আগামী ১৯ তারিখের মধ্যে বিকল্প প্রতীকের চাহিদা দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, শাপলা প্রতীক অন্তর্ভুক্ত করার দরকার নেই বলে কমিশন মনে করে। শাপলা ছাড়া নিবন্ধন না নিলে এটা তাদের বিষয়। এই সময়ের মধ্যে পছন্দ না জানালে ‘স্বীয় পদ্ধতি’তে প্রতীক দেবে ইসি।

গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনে জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘শাপলা’ প্রতীক পেতে সোচ্চার অবস্থান জানান এনসিপি নেতারা। নির্বাচন কমিশন রোববারের মধ্যে নির্ধারিত তালিকা থেকে এনসিপিকে প্রতীক বেছে নিতে বলায় দলটির নেতাদের এই প্রতিক্রিয়া। এদিন এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মুসা এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, এনসিপির মার্কা শাপলা। শাপলা দিতে হবে। এর পরপরই এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম নিজের ফেসবুক পেজে ওই পোস্ট শেয়ার করেন। একই সময়ে এনসিপি দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুকে লেখেন, এনসিপি শাপলাই পাবে। দলের যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মুসা লেখেন, বিষয়টা শুধু শাপলা প্রতীক ইস্যু না।

ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সক্ষমতা প্রমাণের। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, এনসিপিকে কেন শাপলা দেওয়া হবে না, সেটা তিনি জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করবেন না। শাপলা প্রতীক এনসিপিকে বরাদ্দ না দেওয়া ইসির ‘মন-মর্জি’র বিষয় কি নাÑ সেই প্রশ্ন তোলেন এই এনসিপি নেতা। তিনি বলেন, আজকেও (গতকাল মঙ্গলবার) সচিব যা বললেন, তার সারমর্ম আইনগত প্রতিবন্ধকতার ব্যাপার না, শাপলা না দেওয়া কমিশনের মন-মর্জির ওপর নির্ভরশীল। আমরা এটাই বলে আসছি, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে কোনো প্রতিষ্ঠান স্বচ্ছতা এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতার বাইরে থাকতে পারবে না। কোনো প্রতিষ্ঠান বেআইনি, বৈষম্যমূলক ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ করতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট করতে হবে তারা কি জনগণের কাছে মুখাপেক্ষী, নাকি আপাত ক্ষমতার জন্য অপেক্ষমাণ কোনো রাজনৈতিক দল বা বন্দুকওয়ালা কারো মুখাপেক্ষী? জনতার মার্কা শাপলা। এনসিপির মার্কা শাপলা। শাপলা দিতে হবে।

১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে দলের প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে তখনকার বিচারপতি আব্দুর রউফ কমিশন পাঁচটা নীতি অনুসরণ করে, এগুলো হলোÑ ১৯৭৯ সালে এবং তার পরে সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের অনুকূলে বরাদ্দকৃত প্রতীক যথাসম্ভব বহাল থাকবে, রাজনৈতিক দলের অতীত ও বর্তমান সদস্য সংখ্যা, ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ফল বিবেচনায় থাকবে, যেসব রাজনৈতিক দল শুধু বিশেষ একটি প্রতীকের জন্য আবেদন করবে তা সে দলের অনুকূলে সংরক্ষণ করা হবে, একই প্রতীকের জন্য একাধিক রাজনৈতিক দল দাবিদার হলে তাদের সমঝোতার অনুরোধ; ব্যর্থ হলে কমিশন প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে স্বীয় পদ্ধতি অবলম্বন করবে। প্রয়োজনে লটারি হবে, যেসব রাজনৈতিক দল প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে একাধিক পছন্দ থাকবে, তাদের পছন্দ যথাসম্ভব বিবেচনায় রাখবে।

এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় দলটির প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে তৈরি হওয়া এ সংকট নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মন্তব্য করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল লতিফ মাসুম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আপনি যদি মনে করেন এটা বড় বিষয় তাহলে এটা বড় বিষয়। আমার মনে হয় এটা খামোকাই একটা ইস্যু তৈরি করছে। এনসিপির একটা অন্যায় আবদার নিয়ে ‘গো’ ধরে বসে এটা ঠিক না। ইসির তালিকায় যেহেতু শাপলা নেই তাহলে তো দেওয়া সম্ভব নয়। তারা গোলাপ ফুল বা অন্য কিছু নিক। তা না করে তারা শাপলার জন্যই বসে আছে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির কাছে এমন আশা করা যায় না। আমরা চাই না আসন্ন নির্বাচনে শুধু এই একটা ইস্যু নিয়ে কোনো ধরনের অরাজকতা তৈরি হোক। সুষ্ঠু এবং একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য জাতি অপেক্ষা করছে। আশা করি, এনসিপি কম্প্রোমাইজে আসবে।

প্রসঙ্গত, জাতীয় নাগরিক পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য যখন ইসিতে আবেদন করেছিল তখন প্রতীক হিসেবে শাপলা, কলম ও মোবাইল চেয়েছিল। এর কয়েকদিন পরে আবার আরেকটি চিঠি দিয়ে দেয়। ওই সংশোধিত চিঠিতে শাপলা, লাল শাপলা অথবা সাদা শাপলা থেকে যেকোনো একটি প্রতীক চায় এনসিপি। গত বেশ কয়েক মাস ধরেই এনসিপি নেতাকর্মীদের অনেকে শাপলা প্রতীকের দাবিতে বিভিন্ন প্রচারও চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে একাধিকবার দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা পেতে নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠকও করেছে দলটি। তবে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ইসি গত ৩০ সেপ্টেম্বর এনসিপিকে যে চিঠি পাঠায়, সেই চিঠিতে বলা হয়, ৭ অক্টোবরের মধ্যে ইসির তালিকাভুক্ত ৫০টি প্রতীক থেকে পছন্দ যেকোনো একটি প্রতীক নেওয়ার জন্য। একই সাথে ওই চিঠিতে জানানো হয় দলটির প্রথম পছন্দ ‘শাপলা’ বর্তমানে নির্বাচন পরিচালনার বিধিমালার তালিকায় নেই, তাই এটি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ৫০টি মার্কার মধ্যে আলমিরা, খাট, উটপাখি, ঘুড়ি, কাপ-পিরিচ, চশমা, দালান, বেগুন, চার্জার লাইট, কম্পিউটার, জগ, জাহাজ, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মার্কা রয়েছে।

কিন্তু এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব ও আইন সম্পাদক জহিরুল ইসলাম মুসা জানিয়েছেন, তারা নির্বাচন কমিশনকে ই-মেইলের মাধ্যমে চিঠির জবাব দিয়েছেন। এনসিপি ইসিকে জানিয়েছে, শাপলার বাইরে অন্য প্রতীক তারা গ্রহণ করবে না। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম স্বাক্ষরিক চিঠির সঙ্গে শাপলা প্রতীকের সাত ধরনের নমুনাও যুক্ত করে দেওয়া হয়। মুসা সাংবাদিকদের এ বিষয়ে বলেন, যেহেতু শাপলা প্রতীক পেতে আমাদের কোনো আইনগত জটিলতা নেই, সে কারণে আমরা ইসিকে আমাদের আগের অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করেছি। এনসিপি শাপলার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেবে না।