শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


হাসান আরিফ

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৫, ১১:৫৯ পিএম

বাস্তবায়নের শঙ্কা রেখেই জুলাই সনদ স্বাক্ষর

হাসান আরিফ

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৫, ১১:৫৯ পিএম

বাস্তবায়নের শঙ্কা রেখেই  জুলাই সনদ স্বাক্ষর

বহুল আলোচিত ঐতিহাসিক ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও ২৫টি রাজনৈতিক দলের নেতারা এ সনদে স্বাক্ষর করেছেন। এটি নতুন রাজনৈতিক ঐকমত্যের সূচনা হলেও, এনসিপি ও বাম ধারার চারটি রাজনৈতিক দল সনদে স্বাক্ষর না করায় এর বাস্তবায়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে গভীর আশঙ্কা। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগের রাতে এনসিপি ও চার বাম দল উপস্থিত না থাকার ঘোষণা দেয়। এ ছাড়া অনুষ্ঠানের আগে ‘জুলাই-যোদ্ধাদের’ বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, পঞ্চম দফার সংশোধন এবং আইনি কাঠামোর অস্পষ্টতাÑ সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে। অনেকেই বলছেন ঐকমত্য কমিশনের ঐক্য অসম্পূর্ণ থেকে গেল।

গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টা ৩৭ মিনিটে রাজধানীর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। বিকেল সাড়ে ৮টার দিকে দক্ষিণ প্লাজায় পৌঁছান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তার পাশে ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

বিকেল ৫টা নাগাদ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর হয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’। একদিকে উচ্ছ্বাস ও আশার সুর, অন্যদিকে বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তার গুঞ্জনÑ দুই রকম আবহে শেষ হয় প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠানটি। অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিদেশি কূটনীতিবৃন্দ।

২৫ দলের স্বাক্ষর, অনুপস্থিত চার বাম দল ও এনসিপি

ঐকমত্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, মোট ২৫টি রাজনৈতিক দল সনদে স্বাক্ষর করে। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য নেয়ামূল বশির। খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম ও মিডিয়া সমন্বয়ক সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন। আমার বাংলাদেশ পাটির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ও মহাসচিব মোমিনুল আমিন। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ ও মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ও সিনিয়র সহসভাপতি তানিয়া রব। গণ অধিকার পরিষদের (জিওপি) সভাপতি নুরুল হক ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ও রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য বহ্নিশিখা জামালী। জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি- জাগপার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লুৎফর রহমান। ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান।

গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। জাকের পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া ও গাজীপুর জেলা ছাত্র ফ্রন্টের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হাসান শেখ। জাতীয় গণফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক আমিনুল হক টিপু বিশ্বাস ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মঞ্জুরুল আরেফিন লিটু বিশ্বাস। বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল মাজেদ আতহারী ও মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার। বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়্যারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব খন্দকার মিরাজুল ইসলাম। ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ রফিকুল ইসলাম (বাবলু) ও মহাসচিব মোহাম্মদ আবু ইউসুফ (সেলিম)।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহসভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী ও মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল কাদের ও মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী। এবং আমজনতার দলের সভাপতি কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক তারেক রহমান।

তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও চারটি বাম দলÑ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকে।

এনসিপি আগের রাতে জানায়, সনদের আইনি বৈধতা, সাংবিধানিক অবস্থান ও বাস্তবায়নের গ্যারান্টি না পেলে তারা স্বাক্ষর করব না। এ ছাড়া বাম দলগুলো বলেছে, তাদের প্রস্তাবিত রাষ্ট্রীয় মালিকানা, শ্রমিক অধিকার ও সংবিধান সংস্কারের ধারা সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে জাতীয় ঐকমত্যের যে দাবি করা হচ্ছে, তা কার্যত আংশিক থেকে গেছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুই পর্বে আলোচনা করে জুলাই সনদ তৈরি করেছে। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে তারা। জাতীয় পার্টিকে এ আলোচনায় রাখা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫২টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে।

সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও বিক্ষোভ: উত্তপ্ত স্বাক্ষরপর্ব

এদিকে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে সকালের শান্ত পরিবেশ দুপুরের দিকে অস্থির হয়ে ওঠে। দুপুর ১টার দিকে ‘জুলাই-যোদ্ধা’ নামের একটি গোষ্ঠী সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থান নেয়। তাদের দাবি ছিলÑ গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং অংশগ্রহণকারীদের আইনগত দায়মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

পুলিশ লাঠিপেটা করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ইটপাটকেল নিক্ষেপ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং কয়েকটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। আহত হন অন্তত ১২ জন, যাদের মধ্যে তিনজন ‘জুলাই-যোদ্ধা’ সংগঠনের সদস্য বলে জানা যায়। সংঘর্ষের প্রভাব পড়ে সনদের ভাষায়ও। বিকেলেই ঐকমত্য কমিশন বৈঠকে বসে এবং সংশোধন আনে সনদের পঞ্চম দফায়, যা পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠে পুরো সনদের সবচেয়ে আলোচিত অংশ।

সংশোধিত পঞ্চম দফা: শহিদ মর্যাদা ও দায়মুক্তির প্রতিশ্রুতি

প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছিল, গণঅভ্যুত্থান-পূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকা-ের বিচার ও শহিদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা সংশোধনের পর বলা হয়, ‘গণঅভ্যুত্থান-পূর্ব বাংলাদেশে ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকারদের বিচার এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও সহযোগী বাহিনীর হাতে সংঘটিত হত্যাকা-ের বিচার, শহিদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, আহতদের সুচিকিৎসা, শহিদ পরিবার ও ‘জুলাই বীর যোদ্ধাদের’ পুনর্বাসন, মাসিক ভাতা ও আইনগত দায়মুক্তি নিশ্চিত করা হবে।’

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘এটা শুধু একটি ঘোষণাপত্র নয়, এটি জনগণের আন্দোলনের স্বীকৃতি। আমরা ইতিহাসের দায় মেটাতে চাই।’

বাদ যাচ্ছে না স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) চারটি বামপন্থি দলের আপত্তির পর জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর ফলে সংবিধান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ পড়ছে না।

বলা হয়েছিল, বিদ্যমান সংবিধানের ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি সংক্রান্ত ১৫০ (২) অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত হবে এবং এ-সংশ্লিষ্ট পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তপশিল সংবিধানে রাখা হবে না। এই সিদ্ধান্তে ৯টি দল একমত ছিল না।

চূড়ান্ত সনদে বলা হয়েছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০ (২) সংশোধন করা হবে এবং এ-সংশ্লিষ্ট পঞ্চম ও ষষ্ঠ তপশিল সংবিধানে রাখা হবে না।

সংবিধানের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তপশিল যুক্ত করা হয়েছিল ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। পঞ্চম তপশিলে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ। ষষ্ঠ তপশিলে আছে ১৯৭১ সালের ‘২৫ মার্চ মধ্যরাত শেষে অর্থাৎ, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে’ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা। আর সপ্তম তপশিলে আছে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।

অর্থাৎ, জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার হলে তাতে সংবিধানের তপশিলে ৭ মার্চের ভাষণ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা থাকবে না। তবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানের তপশিলে থাকবে।

জুলাই জাতীয় সনদ: প্রতিশ্রুতির দলিল, নাকি বাস্তবায়নহীন কাগজ?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জুলাই সনদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী মুহূর্ত, কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগের পথ অত্যন্ত জটিল। সনদে গণতন্ত্র, জবাবদিহি, প্রশাসনিক সংস্কার, অর্থনৈতিক পুনর্গঠনসহ একাধিক সংস্কারধর্মী প্রতিশ্রুতি থাকলেও কোন সংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে তা বাস্তবায়িত হবেÑ এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর নেই।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিজেকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার সাংবিধানিক ক্ষমতা সীমিত। ফলে সনদে প্রতিশ্রুত কাঠামোগত পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়নের জন্য নতুন আইন, বিধি ও প্রশাসনিক নির্দেশনার প্রয়োজন হবে, যার প্রক্রিয়া এখনো অজানা।

একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মন্তব্য করেনÑ এটা একধরনের রাজনৈতিক ইচ্ছাপত্র। কিন্তু সংবিধান বা আইন সংশোধন ছাড়া এটি কার্যকর করা সম্ভব নয়। তাই এখনই এর বাস্তবায়ন নিয়ে অতিরিক্ত আশাবাদ দেখানো বিপজ্জনক।

প্রধান উপদেষ্টা বললেন, আমরা শুরু করেছি, শেষ করবে জনগণ

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুষ্ঠানে বলেন, ‘এই সনদ আমাদের ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ করবে। এটি সরকারের নয়, জনগণের দলিল। আমরা শুরু করেছি, শেষ করবে জনগণ।’

তিনি বলেন, জুলাই সনদের উদ্দেশ্য হলো একটি নতুন সামাজিক চুক্তি, যেখানে নাগরিক ও রাষ্ট্র পরস্পরের জবাবদিহিমূলক সম্পর্ক পুনর্গঠন করবে। তবে তিনি স্বীকার করেন, বাস্তবায়নের পথ সহজ নয়, তা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্পও নেই।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি

বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ‘দলিলভিত্তিক ঐকমত্য’ নতুন নয়। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের পর ‘সর্বদলীয় চুক্তি’, ২০০৮ সালে ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতিশ্রুতি’ এবং ২০১৮ সালে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার মঞ্চের সনদ’Ñ সব একইভাবে বড় রাজনৈতিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। ইতিহাসের সেই ব্যর্থতার ছায়া এবারও ঘন হয়ে আছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক ইচ্ছা ও প্রশাসনিক সক্ষমতা ছাড়া জুলাই সনদও ‘আদর্শের দলিল’ হিসেবেই থেকে যেতে পারে।

ঐকমত্যের ভিত্তি স্থাপন হলেও থাকছে সংশয়

জুলাই জাতীয় সনদ ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কিন্তু এর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ভিত্তি এখনো দুর্বল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সনদের প্রতিটি দফায় যেমন আশার আলো আছে, তেমনি আছে বাস্তবায়নের সংকটও। বাম দল ও এনসিপির অনুপস্থিতি, পঞ্চম দফায় দায়মুক্তির বিতর্ক, আইনি কাঠামোর অস্পষ্টতাÑ সব মিলিয়ে সনদটি এখন ‘আংশিক ঐক্যের দলিল’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘সনদের চূড়ান্ত মূল্য নির্ভর করবে এর বাস্তব প্রয়োগে। ইতিহাস প্রমাণ করেছেÑ স্বাক্ষর নয়, প্রয়োগই রাজনীতির সত্য। তাই বলা যায়, স্বাক্ষর দিয়ে ঐতিহাসিক সূচনা হলেও বাস্তবায়নের পথ এখনো অনিশ্চিত ও কণ্টকাকীর্ণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারে জুলাই সনদ হয়তো এক নতুন অধ্যায়, কিন্তু সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি এখনো অনেক দূরে।’

একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও বলেন, ‘আমাদের মতের পার্থক্য থাকবে। রাজনীতিতে মতপার্থক্য না থাকলে তা গণতান্ত্রিক হয় না। মতের পার্থক্য থাকবে, পথের পার্থক্য থাকবে, কিন্তু এক জায়গায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’

সেই অভীষ্ট জায়গা গণতন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। প্রত্যাশা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বহু স্রোত যেন মোহনায় এসে মেলে, যেন আমরা বলতে পারি আমাদের অনেক স্রোত, কিন্তু মোহনা একটি। সেটি হচ্ছে, একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ তৈরি করা। আমাদের বহু স্রোত, কিন্তু সবাই এক জায়গায় যেকোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকব।’

আলী রীয়াজ আশা করেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে জাতীয় সনদ হয়েছে, তার বাস্তবায়ন দ্রুততার সঙ্গে ঘটবে। আমরা মনে করি, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য আমাদের যে চেষ্টা, সবার যে চেষ্টা, সেই চেষ্টা এক দিনে সাফল্য অর্জন করবে না। একটি দলিল কেবল সেই নিশ্চয়তা দেবে না। আমরা আশা করি, এই যে জাতীয় দলিল তৈরি হয়েছে, তার বাস্তবায়ন ঘটবে। দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন ঘটবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শামসুল আলম সেলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ফ্যাসিস্ট-বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার ফলেই জুলাই সনদ প্রণয়ন হয়েছে। কিছু দল যেমন এনসিপি সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে স্বাক্ষর করেনি, তবে পরে যোগদানের সুযোগ থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকার ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বাড়িয়ে আলোচনার সুযোগ রাখছে। সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ঐক্য ও আলোচনার মাধ্যমেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করা সম্ভব বলে মত দিয়েছে সরকারপক্ষ।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!