জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। মুখে মুখে ঐক্যের বার্তা থাকলেও এই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত বাড়ছে অনৈক্য। গণভোটসহ নানা ইস্যুতে মুখোমুখি রাজনৈতিক দলগুলো। সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ‘নোট অব ডিসেন্ট’কে পুরোপুরি উপেক্ষা করাকে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বলে মনে করছে বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল। আর ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনে গণভোটের তারিখ ঘোষণা না করায় ক্ষুব্ধ জামায়াতে ইসলাম। দলটির নেতারা বলছেন, গণভোটের সময় যত দেরি হবে, জাতীয় নির্বাচন তত সংকটের মধ্যে পড়বে।
গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায়-সম্পর্কিত সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ করার উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমনের ব্যবস্থায় সংস্কারের সুপারিশ দেওয়ার জন্য ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এ ছয় কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করা হয়। ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে তৈরি জুলাই জাতীয় সনদে এরইমধ্যে ২৫টি দল ও জোট সই করেছে। তারা সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে।
জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে তিন ভাগে বাস্তবায়নের সুপারিশ করে সরকারের কাছে চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তাব দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সুপারিশে প্রথমে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারি, আদেশের প্রশ্নে গণভোট আয়োজন। এর ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকার (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) ক্ষমতা দিয়ে সংস্কার প্রস্তাবগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রস্তাবে সংলাপে ঐকমত্য হওয়া সনদের ৮৫টি প্রস্তারের মধ্যে ৯টি নির্বাহী আদেশে, ২৮টি অধ্যাদেশে এবং সংবিধান সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাব সংবিধান সংস্কার পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্টের বিষয় উল্লেখ্য থাকলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সুপারিশের মধ্যে নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো উল্লেখ নেই। এ ছাড়া সংসদের প্রথম ৯ মাসে (২৭০ দিন) সংবিধান সংস্কার পরিষদ সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে সুপারিশে। অন্যদিকে গণভোটের সুপারিশ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় উল্লেখ না করে আদেশ জারির দিন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত যেকোনো একদিন গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে সুপারিশে।
তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে লেগে আছে বিভেদ। বিশেষ করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে মতানৈক্য সবচেয়ে বেশি। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একদিনে দাবি করলেও জামায়াতে ইসলামীসহ ৭ রাজনৈতিক দল এতে আপত্তি তুলেছে। তারা নভেম্বরের মধ্যে গণভোট আহ্বানের জোর দাবি জানিয়ে পাঁচদফা দাবিতে ৩ নভেম্বর বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে। অন্যদিকে কমিশনের সুপারিশ নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কোনো ধরনের আপত্তি না জানিয়ে বলেছে, আইনি ভিত্তিসম্পন্ন আদেশের খসড়া সরকার গ্রহণ করলে তাদের সনদ স্বাক্ষরের বিষয়েও অগ্রগতি হবে।
এ ছাড়াও বিএনপি জুলাই সনদ ও সুপারিশের মধ্যে ভিন্নতার অভিযোগ তুলে বলেছে এর মাধ্যমে কমিশন জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করেছে বলে অভিযোগ করেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা ঐক্য হতে পারে না। তাহলে এই কমিশন কেন করা হয়েছিল?’ তিনি বললেন, ‘জনগণের সঙ্গে এটা একটা প্রতারণা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এটা প্রতারণা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এত বড় একটা অভ্যুত্থান, এত ত্যাগের বিনিময়ে, এত প্রাণের বিনিময়ে সেটাকে ঠিকভাবে জাতির কল্যাণে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে, ততই বিভক্ত বাড়ছে। বিভক্ত হয়ে পড়াটা, এটা কারা করছেন, কেন করছেন, এটাও উপলব্ধি করতে হবে। মিডিয়াতে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে কতগুলো পক্ষ নিয়ে একেবারে নেমে যাওয়া হয়। প্রতিপক্ষকে একেবারে পুরোপুরি ঘায়েল করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। এখন এখানে (সুপারিশে) এসে এই অবস্থায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে শুধু জাতিতে বিভক্তি হবে, অনৈক্য হবে এবং এখানে কোনো ঐকমত্য হবে না। এর ভিত্তিতে তারা কী অর্জন করতে চায় আমরা জানি না।’
এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠিক সময়ে হবে বলে আশা প্রকাশ করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘তবে নির্বাচন কোনো কারণে পিছিয়ে গেলেও জুলাই সনদের বাস্তবায়ন যেন না পেছায়।’ সে জন্য আগে গণভোট করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। তাহের বলেন, ‘একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হওয়া উচিত নয়। অনতিবিলম্বে গণভোটের তারিখ ঘোষণা করতে হবে।’
অন্যদিকে গণভোটের সময় নির্দিষ্ট না করার সমালোচনা করে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘‘ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেখানে গণভোট কখন হবে, সেটি স্পষ্ট করে বলেনি। এর মাধ্যমে গণভোটের তারিখ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ‘বল’ চলে গেছে সরকারের কোর্টে। এ বিষয়ে এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’’ তিনি বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন যদি সুনির্দিষ্ট করে জাতীয় নির্বাচনের আগে আসছে নভেম্বরে গণভোটের তারিখ ঘোষণা করত, তাহলে ঝামেলা সৃষ্টি হতো না। এখন সরকারের দায়িত্ব খুব দ্রুত গণভোটের তারিখ ঘোষণা করা।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সুপারিশে দেখেছি, নোট অব ডিসেন্টের উল্লেখ নেই। এটা তো কোনো ঐকমত্য হয়নি। এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই কমিশন দেবে। আমরা জুলাই সনদ সই করেছি। সনদে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) লেখা আছে। এটা দলগুলো নিজ নিজ ইশতেহারে দেবে। যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, ম্যান্ডেট পাবে, সেই দল নিজস্ব প্রস্তাব অনুযায়ী আপত্তির অংশগুলোর মীমাংসা করবে।’
জুলাই সনদের আদেশ জারি প্রসঙ্গে জোনায়েদ সাকি আরও বলেন, ‘অনেকে দাবি তুলছেন যে আদেশ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টা আদেশ দেবেন কোন ক্ষমতাবলে? সরকার আদেশ দেয়, সেটা রাষ্ট্রপতির নামে যায়, এটা যেকোনো রাষ্ট্রের নিয়ম। রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন রাষ্ট্রের প্রতীক। যদি প্রধান উপদেষ্টা নিজে এটা জারি করেন, তার মানে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করছেন এবং কার্যত সংবিধানকে স্থগিত করছেন।’
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে এখন অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ দেখার পরই এতে স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এনসিপি। ঐকমত্য কমিশনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে দলটির মুখ্য সমম্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর আস্থা নেই। আসিফ স্যারের ওপরে আস্থা নেই। কমিশন ড্রাফট আকারে যখন হাজির করবে আমরা সেটা পড়ব। যদি দেখি জনগণের সব আশা-আকাক্সক্ষা এবং গণঅভ্যুত্থানকে প্রাথমিক ভিত্তিমূল ধরে নেওয়া হয়েছে তখন আমরা স্বাক্ষর করব।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু এই গণঅভ্যুত্থান থেকে সরকার গঠন হয়েছে, তাই সরকারপ্রধান ডক্টর ইউনূসকে জনগণের সম্মুখে শহিদ মিনারে বাস্তবায়ন আদেশে স্বাক্ষর করতে হবে। কারণ, এই শহিদ মিনার থেকে এক দফা দাবির মাধ্যমে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন হয়েছিল।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে দেশে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। জুলাই সনদের পুরোপুরি বাস্তবায়ন চাই। কারো সঙ্গে জোট বাঁধবে না এনসিপি, আমরা এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘আমরা জুলাই সনদের প্রস্তাবনা ইতিমধ্যে জমা দিয়েছি। এখন সরকার এগুলো নিয়ে কাজ করবে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে অতীতেও অনেক আন্দোলন হয়েছে। সেসব আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। মানুষের আত্মত্যাগের আকাক্সক্ষা অপূর্ণ রয়ে গেছে। কিন্তু এবার যেন ব্যর্থ না হয়।’ তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ে যারা প্রাণ দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, তাদের সবার আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি গণভোটে জুলাই সনদ পাস না হয়। এ জন্য জুলাই সনদ পাস করানোর দায়িত্ব সবার।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন