মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রহিম শেখ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২৫, ১১:৪৫ পিএম

উড়ছেন ডিসকো শওকত পরিবার

রহিম শেখ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২৫, ১১:৪৫ পিএম

শওকত আলী চৌধুরী

শওকত আলী চৌধুরী

  • ব্যাংক হিসাবে ৮ হাজার কোটি টাকা লেনদেন
  • জাহাজ ভাঙার ব্যবসার আড়ালে বিপুল অর্থপাচার
  • লেনদেন ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে
  • সিংগাপুরের ওশান ড্রাইভে দ্যা কোস্ট কমপ্লেক্সে দুটি ফ্ল্যাট ক্রয়
  • দুবাইয়ের লানসি আইল্যান্ডে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বিলাসবহুল ভিলা
  • সম্পদ গড়েছেন যুক্তরাজ্যে
  • বিপুল অর্থ ব্যয়ে মরক্কোতে মেয়ের বিয়ের প্রথম অংশ, দ্বিতীয় অংশ দুবাইয়ে আয়োজন
  • অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ, তদন্তে দুদক

ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরী। যাকে ডিসকো শওকত বলেই অনেকে চেনেন। বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যানও তিনি। মূলত শিপিং ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ী ও তার পরিবার ১৪৬টি করপোরেট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আট হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন করেছেন। যার একটি বড় অংশের লেনদেন হয়েছে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে। অর্থাৎ জাহাজ ভাঙার ব্যবসার আড়ালে বিপুল অর্থপাচারের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সংস্থাটির তদন্তে সিংগাপুরের ওশান ড্রাইভে অবস্থিত দ্য কোস্ট কমপ্লেক্সে ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন সিংগাপুর ডলারে কেনা ২১৯ ও ২১৭ স্কয়ার মিটারের ফ্ল্যাট কেনারও তথ্য মিলেছে। এছাড়া দুবাইয়ের তিলাল আল ঘাফ এলাকার লানসি আইল্যান্ডে অবস্থিত প্রায় ৩০০ কোটি টাকার একটি বিলাসবহুল ভিলা কেনারও তথ্য এসেছে। শওকত আলী চৌধুরী সম্পদ গড়েছেন যুক্তরাজ্যেও। বিএফআইইউ বলছে, শওকত আলী চৌধুরীর পরিবারের মধ্যে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ এ অভিযোগগুলো তদন্ত করছে।

বিএফআইইউ’র প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, শওকত আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী তাসমিয়া আম্বারীন মেয়ে জারা নামরীন ও ছেলে জারান আলী চৌধুরী চারজনের এখন পর্যন্ত ২৮টি ব্যাংকে ১৮৭টি হিসাব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ইবিএল চেয়ারম্যানের নামে ১৪টি হিসাব, তার স্ত্রীর নামে ১৫টি হিসাব, জারা নামরীন এর নামে ৯টি হিসাব ও জারান আলী চৌধুরীর নামে ৩টি হিসাব এবং তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ১৪৬টি হিসাব পাওয়া গেছে।

চলতি বছরের ১৫ জুন পর্যন্ত আসা হিসাব অনুযায়ী এসব ব্যাংক হিসাবে ৮ হাজার ৪০৭ কোটি ৯১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮২ দশমিক ২২ টাকা জমা করা হয়েছে। একই সময়ে ৮ হাজার ২৪৭ কোটি, ৫৬ লাখ ৯২ হাজার ৭৬০ দশমিক ৩১ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ওই সময়ে স্থিতির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৩ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার ১৫৮ দশমিক ১৬ টাকা। উল্লিখিত হিসাবসমূহের কেওয়াইসি, হিসাব বিবরণী এবং অন্যান্য দলিল বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

বিএফআইইউ’র অনুসন্ধানে, শওকত আলী চৌধুরীর পরিচালিত নানাবিধ ব্যাবসায়িক কার্যক্রমের মধ্যে ভেসেল আমদানির উদ্দেশ্যে ২০১২ সাল থেকে তাদের মালিকানাধীন এসএন করপোরেশনের পক্ষে ১৪১টি এলসি সংশ্লিষ্ট দলিল পর্যালোচনাধীন রয়েছে। তার মধ্যে ১১টি এলসির দলিল বিশ্লেষণে ওই এলসি সংশ্লিষ্ট স্ক্রাপ ভেসেলগুলো আদৌ শেষ গন্তব্য হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর কি নাÑ তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে লয়েড লিস্ট ইন্টেলিজেন্স অনুযায়ী একই জাহাজের দুই রকম তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের একই ঠিকানায় রেজিস্ট্রেশনকৃত ৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে স্ক্রাপ ভেসেল কেনার তথ্যও পাওয়া গেছে যা যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি করে। পরবর্তীতে শওকত ও তার পরিবারের সদস্যরা এবং তাদের অন্যান্য ব্যবসার তথ্যও অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়।

বিএফআইইউ’র অনুসন্ধানে বলা হয়, শওকত আলী চৌধুরীর ঢাকা ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখায় পরিচালিত ঢাকা ব্যাংক প্লাটিনাম হিসাবটি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, তিনি হিসাবটি ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি খোলেন এবং ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর বন্ধ করেন। এই ব্যাংক হিসাবে মোট জমার পরিমাণ ৩ হাজার ৯৮৭ কোটি ৯৬ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ দশমিক ৩১ টাকা। এ ছাড়া মোট উত্তোলনের পরিমাণ মোট ৩ হাজার ৯৮৬ কোটি ২৩ লাখ ২ হাজার ৮৩৫ দশমিক ২৪ এবং বন্ধকালীন স্থিতি (ক্লোজিং ব্যালান্স) ছিল ১৭ লাখ ৩০ হাজার ৪৩৯ দশমিক ০৭ টাকা। এ হিসাব ব্যবহার করে তিনি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসএন করপোরেশনের লেনদেন করেছেন যা পরোক্ষভাবে ট্যাক্স ফাঁকির উদ্দেশে করা হয়ে থাকতে পারে বলে বিএফআইইউ’র অনুসন্ধানে সন্দেহ করা হয়েছে।

বিএফআইইউ সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে শওকত আলী চৌধুরী কন্যা জারা নামরীনের অনিয়মও খুঁজে পাওয়া গেছে। ইস্টার্ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় তার ব্যক্তিগত হিসাবে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে ৩১ কোটি টাকার জমা হয়েছে যা তার আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং মাসের শেষের দিকে একটি ক্লিয়ারিং চেকের মাধ্যমে অন্য হিসাবে ৩০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে যা সন্দেহজনক। এসব লেনদেনের প্রাথমিক উৎস হিসেবে কয়েকটি লেনদেনের ক্ষেত্রে শেয়ার লেনদেনের উল্লেখ রয়েছে এবং এ হিসাব থেকে এসএন করপোরেশনের উল্লেখ রয়েছে যা কর ফাঁকির দিকে ইঙ্গিত প্রদান করে। অনুসন্ধানে জারা নামরীন এসএন করপোরেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন বলে কোনো দলিলও পাওয়া যায়নি বলে বিএফআইইউ’র ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

সংস্থাটির অনুসন্ধানে জানা যায়, শওকত আলীর ছেলে জারান আলী চৌধুরীর মিডল্যান্ড ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে ট্রানজেকশন প্রোফাইলের অতিরিক্ত অর্থ জমা ও উত্তোলন করা হয়েছে। এ সঞ্চয়ী হিসাবে এস. এন করপোরেশন থেকে অর্থ জমা হয়েছে এবং সে অর্থ রয়েল ক্যাপিটালের মাধ্যমে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। অর্থাৎ সঞ্চয়ী হিসাব হলেও এর মাধ্যমে ব্যাবসায়িক কর্মকা- সম্পাদন করা হয়েছে যা কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। তা ছাড়া, অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফরমে জারান আলী চৌধুরী এর পেশা দেখানো হয়েছে  বেকার এবং আয়ের উৎস হিসেবে মায়ের ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থ দেখানো হয়েছে। একজন ছাত্রের সঞ্চয়ী হিসাবে বিপুল পরিমাণ ব্যাবসায়িক অর্থ জমা করা এবং সে অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা অত্যন্ত সন্দেহজনক কর্মকা- বিধায় এ বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করা প্রয়োজন বলেও জানানো হয় বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে।

এস. এন করপোরেশনের নামে পরিচালিত মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সিসি (হাইপো) ধরনের হিসাব থেকে শওকত আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী তাসমিয়া আম্বারীনের মালিকানাধীন আরেকটি প্রতিষ্ঠান নামরীন এন্টারপ্রাইজে অর্থ জমা করা হয়েছে এবং শিপ ব্রেকিং খাতের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা করা হয়েছে। তাছাড়া, নিড ড্রেসেস প্রা. লি. নামক একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে ৫০ কোটি ৪০ লাখ টাকা জমা করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এ ছাড়া সিটি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ২০১০ সালের ২৫ জুলাই শওকত আলী চৌধুরীর ব্যক্তিগত হিসাবে এস. এন করপোরেশন থেকে ৩ কোটি টাকা জমা হয়েছে এবং সে অর্থ ওইদিনই মিডওয়ে সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ হয়েছে। তা ছাড়া, এই হিসাবে ২০১৩ সালের ২৯ জুন ১০৬ কোটি ৮০ কোটি টাকা জমা হয়েছে এবং পরবর্তীতে এ অর্থ এস.এন করপোরেশনে পাঠানো করা হয়। অর্থাৎ ব্যক্তিগত হিসাব ব্যবহার করে ব্যবসায়িক লেনদেন সম্পন্ন করা হয়েছে যা কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকতে পারে বলে অনুসন্ধানে বলা হয়।

বিএফআইইউ’র প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর প্রিমিয়ার ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা কর্তৃক গ্রাহক এস.এন করপোরেশনের একটি ঋণপত্রের বিপরীতে গ্রাহকের আমদানি দায় পরিশোধের জন্য গ্রাহককে একই বছরের ১৫ অক্টোবর ২৬৯ কোটি ৪৬ লাখ ৭ হাজার ৬৪৬ দশমিক ৯০ টাকার এলটিআর সুবিধা প্রদান করে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই শওকত আলীর ওই প্রতিষ্ঠানকে ওই সময়ে গ্রাহককে বর্ণিত এলটিআর সুবিধা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ১০ই অক্টোবর ২০১৫ প্রধান কার্যালয় থেকে শাখা বরাবর ওই এলটিআর পোস্ট-ফ্যাক্টো অনুমোদন প্রেরণ করা হয় যা শাখা কর্তৃক ১৪ অক্টোবর গৃহীত হয়। অর্থাৎ, ঋণ সুবিধা প্রদানের কোনো অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও গ্রাহককে সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে ব্যাংকিং রীতি নীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে ওই এলটিআর দেওয়া হয়।

বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখা কর্তৃক এসএন করপোরেশনের পক্ষে খোলা তিনটি ঋণপত্রের বেনিফিসারি ছিল তিনটি ব্রিটিশ আইল্যান্ড নিবন্ধিত কোম্পানি। বেনিফিসিয়ারি প্রতিষ্ঠান তিনটি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত যা গাইডলাইন্স ফর প্রিভেনশন অব ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিংয়ে একটি এলার্ট হিসেবে উলেখ রয়েছে এবং এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃক এনহেন্স ডিউ ডিলিজেন্স করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংক কর্তৃক সঠিকভাবে ইডিডি না করে ওই ঋণপত্রগুলো স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়াও, গাইডলাইন্স ফর ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রানজেকশন্স-২০১৮, ভলিউম-১ এর ০৭ অধ্যায়ের সেকশন-(রর) এর ২৩ (বি) নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত নিদের্শনা লংঘনপূর্বক বিদেশি সরবরাহকারীর আর্থিক সচ্ছলতাসহ গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ না করেই শাখা কর্তৃক বর্ণিত এলসি স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়াও, বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান তিনটি একই ঠিকানায় নিবন্ধিত। এ ছাড়াও, উন্মুক্ত অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠান তিনটির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

বিএফআইইউ’র একটি সূত্র জানিয়েছে, শওকত আলীর শিপিং কোম্পানি এসএন করপোরেশনের নামে খোলা একাধিক এলসিতে অসংগতি পাওয়া গেছে। এসব এলসি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে নিবন্ধিত কিছু কোম্পানির নামে খোলা হয়, যেগুলোর ঠিকানা এক এবং কার্যক্রম যাচাইযোগ্য নয়, যা বাণিজ্যিক আড়ালে অর্থ পাচারের ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করছে সংস্থাটি। অর্থাৎ কথিতভাবে অফশোর (বিদেশে নিবন্ধিত) কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করেছেন ‘স্ক্রাপ জাহাজ ক্রয়’ এর নামে। এই অর্থের একটি অংশ দিয়ে সিংগাপুরের ওশান ড্রাইভে অবস্থিত দ্যা কোস্ট কমপ্লেক্সে ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন সিংগাপুর ডলারে কেনা ২১৯ ও ২১৭ স্কয়ার মিটারের ফ্ল্যাট কিনেছেন। এ ছাড়া দুবাইয়ের তিলাল আল ঘাফ এলাকার লানসি আইল্যান্ডে অবস্থিত প্রায় ৩০০ কোটি টাকার একটি বিলাসবহুল ভিলার কিনেছেন শওকত আলী চৌধুরী। বিপুল সম্পদ গড়েছেন যুক্তরাজ্যে। বিএফআইইউর তথ্যমতে, তদন্ত শুরু হওয়ার পর তারা বিদেশি সম্পদ বিক্রির উদ্যোগ নেন শওকত। আইনজীবীর দাখিল করা নথি অনুযায়ী, দুবাইয়ের তিলাল আল ঘাফ এলাকার লানসি আইল্যান্ডে অবস্থিত প্রায় ৩০০ কোটি টাকার একটি বিলাসবহুল ভিলা বিক্রির জন্য তোলা হয়েছে। আবেদনকারী ওই সম্পদ জব্দ করার ও বিদেশে অর্থ স্থানান্তর রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। তবে বিএফআইইউ’র এক সিনিয়র কর্মকর্তা, যিনি তদন্ত এগিয়ে নিচ্ছিলেন, তাকে পরে পদচ্যুত করা হয় বলে জানা গেছে। তদন্তটি শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পৌঁছানোর আগেই বন্ধ হয়ে যায়, যা রাজনৈতিক প্রভাব ও দায়বদ্ধতার ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

এদিকে গত ১ জুলাই শওকত আলী চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যদের সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে বিএফআইইউ। পরে ৩০ জুলাই সেই স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক তানভীর হাসান স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত এক আদেশে ওই সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘মো. শওকত আলী চৌধুরী, তাসমিয়া আম্বারীন, যারা নামরীন ও মো. জারান আলী চৌধুরী এবং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত হিসাবের লেনদেনের ওপর আরোপিত স্থগিতাদেশ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২৩(১) (গ) ধারার আওতায় ৩১ জুলাই থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ত্রিশ দিন বর্ধিত করার জন্য আপনাদের নির্দেশ প্রদান করা হলো। স্থগিতাদেশের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯ এর ২৬(২) বিধি প্রযোজ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।’

জানতে চাইলে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অর্থপাচারের দায় শুধু বাংলাদেশ সরকারের নয়; বরং যেসব উন্নত ও ধনী দেশ এই পাচারকৃত অর্থের গন্তব্য, তাদেরও সমানভাবে দায় আছে। তিনি আরও বলেন, এই দেশগুলোকে উচিতÑ বাংলাদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে রাখা অবৈধ সম্পদ চিহ্নিত করে জব্দ করা, এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে দেওয়া।’

মেয়ের বিয়ের প্রথম অংশ মরক্কোতে, দ্বিতীয় অংশ দুবাইয়ে আয়োজন

শওকত আলী চৌধুরীর মালিকানাধীন এস এন শিপ ইয়ার্ডে, গত ১২ বছরে দুর্ঘটনায় ১৮ জন শ্রমিক মারা গেছেন। জানা গেছে, জাহাজ ভাঙার সঙ্গে জড়িত এই প্রতিষ্ঠানটি শ্রমিকদের সুরক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। একের পর দুর্ঘটনা ঘটলেও শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পোশাক, মাথার হেলমেট, হেভি গ্লাভস, প্রোটেকশন বুট যথাযথভাবে প্রদান করা হতো না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন, ২০১৮ এবং বিপজ্জনক বর্জ্য ও জাহাজভাঙার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা অনুযায়ী জাহাজভাঙা শিল্পে শ্রমিক সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চত করার সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। দেশ-বিদেশে মিলিয়ন ডলার খরচ করে নিজ সন্তানদের বিয়ের আয়োজন করা এই শওকত বিয়ের অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের অর্থ পরিশোধ করেন না বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

২০১৩ সালে তার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে ইকেবানা নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ফ্লোরাল ডেকোরেশনের কাজ দেওয়া হয়। ইকেবানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিসেস নিলুফার ফারুকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন দেশ থেকে শওকতের চাহিদা অনুযায়ী ফুল ও ডেকোরেশনের আয়োজন করা হয় এবং সফলভাবে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করার পর মোট বিল (১ কোটি ১৭ লাখ টাকা) হতে ৫৭ লাখ টাকা শওকত কখনোই পরিশোধ করেননি। বরং পাওনা টাকা চাইতে গেলে নিলুফার ফারুক ও তার সহকর্মীকে চরমভাবে অপদস্থ করা হয়। বয়োবৃদ্ধা এই উদ্যোক্তা বর্তমানে জটিল কিডনি রোগে আক্রান্ত। শওকতের ৫৭ লাখ টাকার ফুল ডেকোরেশনের বকেয়া বিল, এখনো তাকে ভোগাচ্ছে। এদিকে নির্বিকার শওকত আলী চৌধুরি আগামী ১২-১৪ নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমিরেটস প্যালেস হোটেল ভাড়া করেছেন। উপলক্ষ তার ছোট মেয়ের বিয়ে। জানা গেছে, এরইমধ্যে মরক্কোতে বিয়ের প্রথম অংশ সম্পন্ন হয়েছে মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন।

তদন্তে নেমেছে দুদক

বর্তমানে দুদকের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ শওকত আলী চৌধুরী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ৮ হাজার কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগগুলো তদন্ত করছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ও ৮ অক্টোবর দুটি পৃথক চিঠির মাধ্যমে আইনজীবী কামরুল ইসলাম দুদকে অভিযোগ করেন। বাংলাদেশ  ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে শওকত আলী ও তার পরিবারের নামে থাকা ব্যক্তিগত ও ব্যাবসায়িক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক পরিমাণ অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়ার কথা চিঠিতে উল্লেখ করেন এই আইনজীবী। দুদকের যাচাই কমিটি অভিযোগগুলো প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে এখন আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান শুরু করেছে।

নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অসত্য ও বিভ্রান্তিকর বলছেন শওকত আলী চৌধুরী

বিএফআইইউ’র অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে শওকত আলী চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে রূপালী বাংলাদেশ। কিন্তু তার দুটি মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগের প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে শওকত আলী চৌধুরী বলেন, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম আমার নাম জড়িয়ে ক্রমাগত অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য-উপাত্ত সংবলিত খবর প্রকাশ করছে, যা অনভিপ্রেত।’ তিনি বলেন, ‘এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা, মনগড়া ও বানোয়াট খবরে প্রকাশ পাচ্ছে যে আমি ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যানের পদে থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছি। আমি এসব ভিত্তিহীন খবরের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’ শওকত আলী চৌধুরী বলেন, ‘কিছুদিন যাবৎ দেশের কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল, সংবাদমাধ্যম, টিভি চ্যানেলসহ একটি স্বার্থান্বেষী মহল আমাকে জড়িয়ে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশ করছে। শুধু তা-ই নয়, এ কুচক্রী মহলটি বিভিন্নভাবে আমার নামের সঙ্গে ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির নামকে জড়িয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত সব নিয়ম-নীতি মেনে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং এর ব্যত্যয়েরও কারো কোনো সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমাকে জড়িয়ে ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি-সংক্রান্ত ব্যাপারে কর্তৃপক্ষেরও কোনো অভিযোগ নেই। সুতরাং ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান কর্তৃক ৮ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অসত্য ও বানোয়াট অভিযোগ-সংবলিত প্রকাশিত খবর সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। সরকারের সংশ্লিষ্ট যেকোনো প্রতিষ্ঠান যাচাই করতে চাইলে এ বিষয়ে আমার পক্ষ হতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা করা হবে।’ ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাকে জড়িয়ে এই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করে ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান হিসেবে আমার সুনাম ক্ষুণœ করার প্রচেষ্টায় বিভ্রান্ত না হতে সবাইকে বিনীত অনুরোধ করছি।’

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!