বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠ গত সাত দিন ছিল উত্তেজনায় ভরা। অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের সময় নির্ধারণ নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল, তা এখন পরিণত হয়েছে গভীর অনিশ্চয়তায়। এরই মধ্যে সরকার আগামী বৃহস্পতিবারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত আলোচনায় তুলতে যাচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সেই পরিচিত ‘শেষ মুহূর্তের অচলাবস্থা’তেই দাঁড়িয়ে, কেউ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না, আবার কেউ সিদ্ধান্তের ভার নিতে রাজিও নয়।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং গণভোটের সময় নির্ধারণÑ এই দুই বৃত্তে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে। সাত দিনের সময়সীমায় কোনো দল এগিয়ে না আসায় এখন রাষ্ট্রই হবে সিদ্ধান্তদাতা। তাই আগামী বৃহস্পতিবারের বৈঠক আর একটি প্রশাসনিক মিটিং নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে দেওয়ার সম্ভাব্য বাঁকবদলের সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল মনে করছেন।
গত ২ নভেম্বর জরুরি বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘জুলাই সনদের মৌলিক প্রশ্নগুলো নিয়ে সাত দিনের মধ্যে একটা গ্রহণযোগ্য সমঝোতা তৈরি করুন।’ কিন্তু সেই ডাক বাস্তবে পরিণত হয়নি। সাত দিনের সময়সীমা শেষে সরকার এখন দাঁড়িয়ে আছে দুই বাস্তবতার মুখোমুখি, প্রথমত রাজনৈতিক দলগুলো কথা বলতেই বসেনি আর দ্বিতীয়ত দেশ অপেক্ষা করছে সরকারের পরবর্তী সিদ্ধান্তের।
জামায়াত ছাড়া প্রায় সব দল সরকারের দেওয়া সময়সীমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তবে জামায়াতের উদ্যোগও বাস্তবে কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি। একমাত্র যোগাযোগ হয়েছে ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্কের ওপর ভর করে। এ অবস্থায় গণভোটের আলোচনা আবার ফিরে এসেছে জাতীয় রাজনীতির শীর্ষে। জুলাই সনদ কার্যকর হবে নাকি স্থগিত থাকবেÑ তার সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে দেশের নির্বাচনি সময়সূচি।
বিএনপি নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে চায়। যদিও বিএনপির অবস্থান রাজনৈতিকভাবে কৌশলী। দলটি সংঘাত সৃষ্টি না করে অবস্থান স্পষ্ট রাখা আর জনমতকে সামনে রেখে সরকারের ওপর চাপ বজায় রাখার কৌশল নিয়েছে।
বিএনপি নেতা ইসমাঈল জবিউল্লাহর মতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ যদি জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে হয়, তবে প্রতিক্রিয়া অবশ্যই রাজনৈতিক হবে।
জামায়াত ও সমমনা আট দল বলছে, নির্বাচনের আগে গণভোট ছাড়া সমাধান নেই। জামায়াত ও সমমনা আট দলের যুক্তি আরও সরাসরি। তাদের দাবি, গণভোট আগে না হলে জুলাই সনদের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আর নির্বাচনও প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।
জামায়াতের এহসানুল মাহবুব জোবায়ের বলেছেন, ‘আমরা আলোচনায় প্রস্তুত। কিন্তু সাড়া পাচ্ছি না। তাই সরকার থেকেই ন্যায্য সিদ্ধান্ত আশা করছি।’ এই বার্তায় স্পষ্ট হচ্ছে, দলগুলো নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে, কিন্তু কেউ কারো কাছে এগোচ্ছে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার পর সরকারের ওপর চাপ এখন বহুগুণ বেড়েছে। সরকারি সূত্র বলছে, সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। তবে হুট করে নয়। প্রধান উপদেষ্টা শিগগিরই প্রধান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। যা ইঙ্গিত করে, সরকার এখন মধ্যস্থতার অবস্থান থেকে সরে এসে সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দু হতে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘যখন রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতা করতে ব্যর্থ, তখন রাষ্ট্রই একমাত্র বিকল্প। তবে সেই বিকল্পের দায়িত্বও অত্যন্ত ভারী।’ গণভোট কখন হবে, কীভাবে হবে, এই প্রশ্নটাই এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাপকাঠি হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ গণভোটের সময় নির্ধারণ একটি শুধু তারিখ নয়। এটি দেশের নিরাপত্তা, প্রশাসনিক প্রস্তুতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ভোটারদের আস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
বিশ্লেষকদের মতে, একই দিনে নির্বাচন হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা জটিল হবে, ভোটকেন্দ্রে অতিরিক্ত চাপ পড়বে। আর আলাদা দিনে হলে, বিরোধী দলগুলো তা নিয়ে নতুন রাজনৈতিক বিরোধ তৈরি করবে। একইভাবে জনগণের প্রত্যাশা উপেক্ষা করলে উত্তেজনা বাড়বে, রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন মাত্রা পাবে।
এদিকে আজ মঙ্গলবার সমমনা ৮ দলের জনসভা কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে। এখানে গণভোটবিষয়ক কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা হতে পারে। গত রোববার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যৌথ আন্দোলনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করতে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তারা সরকারের কাছে ১০ নভেম্বরের মধ্যে গণভোটের তারিখ ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু সরকার তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
বিএনপি এখনো কর্মসূচি ঘোষণা না করলেও নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট, পরিস্থিতি যদি তাদের রাজনৈতিক পরিসীমায় আঘাত করে, তবে পাল্টা উদ্যোগ নেওয়া হবে। এই দুটি শক্তি মুখোমুখি হলে দেশের রাজনৈতিক তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাবে বলেই সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, মধ্যস্থতা ছাড়া এই সংকট আরও গভীর হবে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভেতরে সমঝোতায় অক্ষম বা মত আর আদর্শর বিরোধের কারণে তারা তা করতে চায় না। অপর দিকে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো গণভোট বা নির্বাচন জনগণের কাছে বৈধতা পাবে না। আর শেষ কথা হচ্ছে, সরকার যদি জনমতকে অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে উত্তেজনা কমবে। নয়তো রাজনৈতিক পরিবেশ ঝুঁকির মুখে পড়বে।
গতকাল ঠাকুরগাঁওয়ে এক সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘কিছু কিছু দল বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। আর জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’ তার কথায় অস্থির অবস্থা ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করছে নির্বাচনবিমুখ দলগুলো। তিনি পিআরসহ আরও সব অমীমাংসিত বিষয় সমাধান করে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এ দেশের মালিক জনগণ। জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিএনপি সবসময় সংগ্রাম করে আসছে। আগামীতেও সেই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’
একই এলাকায় গত রোববার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি আসছে তারা গণভোট আর সনদের মতো বিষয় জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। মানুষ এসব বিষয় বোঝে না, তারা শুধু ভোট দিতে চায়।’
এনসিপি সরকারের পদক্ষেপে অসন্তোষ প্রকাশ করে জানায়, পরামর্শ প্রক্রিয়ার এই পদ্ধতি নতুন অচলাবস্থা তৈরি করেছে এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে। এনসিপি নেতারা মনে করেন, অর্থবহ সংলাপ শুরু ও পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের, রাজনৈতিক দলগুলোর নয়।
গণতন্ত্র মঞ্চ জোটও একই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট আয়োজন নিয়ে বিরোধ শুধু রাস্তায় আন্দোলন বা অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য নয়।
জোটের নেতারা জোর দিয়ে বলেন, সরকারকে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে এবং একটি সমাধান করতে হবে, যা সর্বাত্মক রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রতিফলন ঘটায়।
গত রোববার এনসিপির সদস্য সচিব আকতার হোসেন বলেন, ‘সরকারের উচিত নয় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, দলগুলো ইতোমধ্যে আলোচনা করেছে এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। এখন সেই সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজনৈতিক সংকট দূর করতে এবং নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।’
আকতার হোসেন আরও বলেন, ‘দেশের মানুষ দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে।’
এদিকে গণভোট নিয়ে সরকার শিগগিরই সিদ্ধান্ত দেবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, ‘এ নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আর আলোচনায় বসবে না। অন্তর্বর্তী সরকার নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে।’
নির্বাচন আর গণভোট একসঙ্গে করা বা আগে করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘একসঙ্গে বসে সরকার সামষ্টিকভাবে সিদ্ধান্তটা নেবে। আপনাদের খুব দ্রুতই এটা আমরা জানিয়ে দেব।’
নির্বাচনের আগে গণভোট করার যৌক্তিকতা আছে কি নাÑ জানতে চাইলে সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, ‘এ বিষয়ে ব্যক্তিগত মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের অংশ হিসেবে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। সরকার যখন বসবে এ বিষয়ে আলোচনা করবে। যখন সিদ্ধান্ত হবে তখন সেটা আপনারা জানবেন।’
এ ছাড়া, সরকার সর্বোচ্চ দিয়ে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে পতিত সরকার বা কোনো অশুভ শক্তি অস্থিরতার চেষ্টা করলে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে সরকার।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন