ঢাকা শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৫

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে কতটা প্রভাব ফেলবে ‘শেখ হাসিনা ইস্যু’

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৫, ১২:৫৮ এএম

২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-ের রায় দেওয়ার পর এটি বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে কী ধরনের কিংবা কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। আবার মাস তিনেকের পরই বাংলাদেশে যেই নির্বাচন হওয়ার কথা, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘শেখ হাসিনা ইস্যু’ দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে কতটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে কিংবা আদৌ কোনো বাধা হবে কি না সেদিকেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের।

গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ক্ষমতায় আসা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এমনিতেই অনেকটা তলানিতে। এমন প্রেক্ষাপটে এখন শেখ হাসিনার মামলার রায়ের পর নতুন করে সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি কেমন হবে, তা নিয়ে কৌতূহল আছে অনেকের।

শেখ হাসিনার মামলার রায়ের পরই বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে যে, তারা শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য ভারত সরকারকে ‘নোট ভারবাল’ পাঠিয়ে আবারও অনুরোধ জানাবে। অন্যদিকে ভারত ওই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবগত। এর মধ্যেই বুধবার দিল্লিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান। তবে তাদের ‘দ্বিপাক্ষিক ইস্যু’র আলোচনাতে শেখ হাসিনা ইস্যু ছিল কি না তা এখনো জানা যায়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা ইস্যুতে মি. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার ইঙ্গিত কম এবং সে কারণে প্রত্যর্পণ ইস্যুতে এই সরকারের অনুরোধে দেশটির সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাদের মতে, নির্বাচনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় আসলে সম্পর্ক কতটা স্বাভাবিক হবে তা মূলত নির্ভর করবে নতুন সরকারের বৈশিষ্ট্য ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। পাশাপাশি ভারত সেই সরকারের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চাইবে তা-ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।

প্রসঙ্গত, গত ১৭ নভেম্বর ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদ- এবং সাবেক আইজিপি ও মামলার রাজসাক্ষী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদ- দিয়েছেন। এর মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান ভারতে রয়েছেন, আর মি. মামুন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।

শেখ হাসিনার মামলায় ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, সরকারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য ভারতের কাছে আবারও অনুরোধ করা হবে। এর পরপরই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালকে হস্তান্তরের জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেয়। ‘আমরা ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন অনতিবিলম্বে দ-প্রাপ্ত এই দুই ব্যক্তিকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে,’ বিবৃতিতে বলা হয়।

এর আগেও অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করলেও ভারত সরকার এ বিষয়ে কখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ভারত সরকারের এ বিষয়ে এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক অবস্থান হলো, “একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে এ দেশে ‘সাময়িক’ (ফর দ্য টাইম বিয়িং) আশ্রয় দেওয়া।”

বাংলাদেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলছেন, প্রত্যর্পণ একটি জটিল বিষয় এবং এ ক্ষেত্রে কাউকে প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে মৃত্যু হুমকির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। “বাংলাদেশে তো শেখ হাসিনার মামলায় মৃত্যুদ-ই দেওয়া হয়েছে। ফলে সেই হুমকিটি তো আছেই। ফলে আপাতত এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে দুই দেশের সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক হচ্ছে না। তবে প্রশ্ন হলো, এই ইস্যুতেই দুই দেশের সব কিছু আটকে থাকবে কি-না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এখন যে প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে, তাতে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরই হস্তান্তরের অনুরোধ করার সুযোগ থাকে। কিন্তু তারপরেও ওই চুক্তিতে এমন অনেক বিষয় আছে, যেগুলো বিবেচনায় নিয়ে এমন অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের সুযোগও রয়েছে। মিজ দত্ত বলছেন, বাংলাদেশের আদালতে শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-ের রায়ের পর এটা এখন পরিষ্কার যে, বাংলাদেশে তার মৃত্যু হুমকি রয়েছে এবং এটিই ভারত সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে হস্তান্তর না করার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করেন তিনি।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে ভারত সরকারের সম্পর্ক একেবারেই তলানিতে। এমনকি ভারতে বসে শেখ হাসিনা সংবাদ মাধ্যমে যেসব কথাবার্তা বলছেন তা নিয়েও বারবার উষ্মা প্রকাশ করে কোনো ফল পায়নি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার।

এদিকে বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলছেন, এটা নির্ভর করবে আগামী সরকার কীভাবে বা কোন কৌশলে ইস্যুটি মোকাবিলা করবে তার ওপর। “এখানে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হবে। প্রথমত, নির্বাচনের পর বাংলাদেশে কী ধরনের সরকার হয়। দ্বিতীয়ত সেই সরকারের সঙ্গে ভারত কোন ধরনের সম্পর্ক করতে আগ্রহী এবং তৃতীয়ত, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ কী ধরনের ভূমিকা নেয়, রাজনীতিতে কতটা সক্রিয় হয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। তার মতে, শেখ হাসিনা ইস্যুকে একপাশে রেখে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা তখন দুই দেশের সরকার করতে পারে। আবার এটিকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ সরকার তাদের দাবি-দাওয়াগুলো বারবার তুলে ধরার চেষ্টাও করতে পারে।

“আবার আওয়ামী লীগ সক্রিয় বেশি হলে সরকারও শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের দাবিটিতে জোর দিতে পারে। তখন সম্পর্ক কেমন হয় সেটিও দেখার বিষয় হবে। ফলে বাংলাদেশের নতুন সরকারের চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হয় তার ওপর দুই দেশের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি অনেকটা নির্ভর করবে,” বলেন মি. কবির।