হিমশীতল বাতাস প্রকৃতিতে নিয়ে এসেছে শীতের বার্তা। অন্যান্য বছর এই সময়টাতে ডেঙ্গুর সংক্রমণ থাকে নিম্নমুখী। কিন্তু চলতি বছর যেন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর সংক্রমণও। গতকাল নভেম্বরের ২০ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে পৌঁছেছে ১৭ হাজার ৪৫৬ জনে। নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে গতকাল পর্যন্ত মারা গেছেন ৭০ জন। যা চলতি বছর এক মাসের হিসাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। শুধু তা-ই নয়, মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছুঁতে যাচ্ছে ১ লাখের ঘর। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে ডিসেম্বরে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর আবাসিক ধরনের ডেঙ্গু মশার (এডিস ইজিপ্টাই) পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের বুনো ডেঙ্গু মশাও (এডিস এলবোপিকটাস) ডেঙ্গুর বাহক হিসেবে কাজ করছে। তাই আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। তাই এসব মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে না পারলে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হবে না বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া, এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮৮ হাজার ৪৫৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এ বছর নভেম্বরেও কেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আগেই বলেছি চলতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশ ব্যাপক থাকবে। আমরা প্রতিদিন এডিস মশার ঘনত্ব নিয়ে কাজ করি। আমরা দেখছি এখনো এডিস মশার ঘনত্ব কমেনি।’ তিনি বলেন, ‘এডিস মশার ঘনত্ব যখন ২০-এর ওপরে থাকে, তখন ধরে নেওয়া হয় এডিস মশা বাড়বে। এডিস মশার ঘনত্বের পাশাপাশি কোনো জায়গায় যদি ডেঙ্গুরোগী থাকে, তাহলে এডিস মশা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। বর্তমানে আমাদের এডিস মশাও আছে আবার রোগীও আছে, দুইটা বিষয় যখন একসঙ্গে থাকে তখন ডেঙ্গু বাড়বে এবং সেটা থাকবে। এ কারণেই আমরা আগেই বলেছিলাম, এবার নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ডেঙ্গু বেশ ভালো আকারে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তবে এর জন্য মশার প্রজনন যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত উড়ন্ত মশাগুলোকে মারার ব্যবস্থা করতে হবে এবং কেউ যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, তাকে পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু নিশ্চিত হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের অনেকগুলো ব্যবস্থার কথা আমি বলেছিলাম। কিন্তু এখন না শুধু, কখনোই আমাদের কথা কেউ শোনেনি। সরকার পরিবর্তনেরও মশা নিধন কার্যক্রমে বড় একটা ধাক্কা লেগেছে। তাই সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে বলে আমি মনে করি।’
তবে সরকারের চেয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে পারলে একজনও মারা যেত না। প্রতিদিন ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে। ডেঙ্গুতে কি মারা যাওয়ার কথা ছিল, একদমই ছিল না। আমরা যদি সচেতনতা বাড়াতে পারতাম, যেসব জায়গায় ডেঙ্গুর লার্ভা হচ্ছে, সেগুলো যদি মূলোৎপাটন করতাম, তাহলে ডেঙ্গুতে একজন মানুষও মারা যেত না। কিন্তু কে কার কথা শুনছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার দায়িত্ব আছে, আমরা সবাই মিলে যদি একসঙ্গে কাজ করি, তাহলে আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারব। এই বিশ্বাস আমার আছে, বাঙালি অনেকবার দেখিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের ছাত্র এবং কর্মজীবী মানুষেরা, আমরা তাদের যদি কাজে লাগাতে পারি, অনেক কিছুই করতে পারব।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০০০ সালে দেশে সাড়ে পাঁচ হাজারজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০০১ সালে আড়াই হাজার আক্রান্ত হন এবং ৪৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০০২ সালে ছয় হাজার ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে ৫৮ জন মারা যান। ২০০৩ সালে ৪৮৬ জনের মধ্যে ১০ জন, ২০০৪ সালে চার হাজারের মধ্যে ১৩ জন, ২০০৫ সালে এক হাজারের মধ্যে চারজন, ২০০৬ সালে দুই হাজারের মধ্যে মৃত্যু হয় ১১ জনের। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আড়াই হাজার ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও কারো মৃত্যু হয়নি। ২০১১ সালে দেড় হাজার ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে ৬৭১ জনের মধ্যে একজন, ২০১৩ সালে প্রায় দুই হাজারের মধ্যে দুজন ডেঙ্গুরোগী মারা যান। ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে কেউ মারা যাননি। ২০১৫ সালে তিন হাজারের মধ্যে ছয়জন, ২০১৬ সালে ছয় হাজারের মধ্যে ১৪ জন, ২০১৭ সালে তিন হাজারের মধ্যে আটজন, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জনের মধ্যে ২৬ জন, ২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জনের মধ্যে ১৭৯ জন মারা যান। ২০২০ সালে দেড় হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয় চারজনের। আর ২০২১ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সাড়ে ২৮ হাজার, মারা যান ১০৫ জন। ২০২২ সালে সর্বমোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন এবং মোট ২৮১ জন মারা যান। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়, পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।
দিন দিন ডেঙ্গুর সংক্রমণ কেন বেড়ে চলেছে দেশেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধের যে স্তরগুলো রয়েছে, তার প্রথম ধাপ হচ্ছে এডিস মশা নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ। দেশব্যাপী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত কোনো কার্যক্রম বা পরিকল্পনা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। ফলে মশা মারার যে কার্যক্রম, সেটি কখনোই শুরু হয়নি। কিছু কিছু স্থানভিত্তিক মশা মারার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল; কিন্তু মশা মারতে সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছাসেবক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় পরিষদের লোকজনসহ সবাইকে যুক্ত করাও হয়নি। মানুষ তার বাড়িঘরে কীভাবে এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করবে, হাতে কলমে সেটা শেখানোর কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ, সেটাও আমরা দেখিনি। এর আগে যে ওষুধগুলো ব্যবহার হয়েছে, সেগুলো খেয়ে মশা মারা যায়নি। এই সুযোগে ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছে। সারা দেশে ডেঙ্গুর হটস্পট ম্যানেজমেন্টও দেখা যায়নি। ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন দেওয়ার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নেই। অন্যদিকে এডিস মশার বিষয়েও কোনো গবেষণাও আমরা করছি না। আমরা দেশে ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কারের কোনো কার্যক্রম শুরু করিনি। এসব কারণেই মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আর তাই দিন দিন ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েই চলেছে।’
এদিকে ডেঙ্গুর তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীদের ভিড়। মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতাল, শহিদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের ভিড়ে তিলধারণের জায়গা নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিট না পেয়ে অনেক রোগী মেঝে, বাথরুমের সামনে ফাঁকা জায়গায়, এমনকি সিঁড়ির সামনের খালি জায়গায়ও ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সরেজমিন রাজধানীর হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ড রোগীতে পরিপূর্ণ। এমনকি অন্যান্য ওয়ার্ডেও রোগী ভর্তি করতে হচ্ছে। একমাত্র ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালটিতেও রোগীর তিলধারণের জায়গা নেই।
দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় গত জুলাই মাসে ২০ শয্যার ডেডিকেডেট ডেঙ্গু ইউনিট গঠন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটির নতুন ভবনের চারতলায় অবস্থিত ডেঙ্গু ওয়ার্ডে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে ঢোকার রাস্তা থেকে শুরু করে ওয়ার্ডের ভেতর পর্যন্ত রোগীতে ভরপুর। ওয়ার্ডটিতে শুধু পুরুষ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে, যাদের অধিকাংশই হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ছাড়া, ডেঙ্গু আক্রান্ত নারী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে একই ভবনের ৮ তলায় মেডিসিন বিভাগে। সেখানে অন্য রোগীদেরও চিকিৎসা চলছে।
তুলনামূলকভাবে কম রোগী থাকলেও ডিএনসিসির কোভিড হাসপাতালটিতেও ভিড় করছেন রোগীরা। এ কয়দিনে রোগী এত বেড়েছে যে, এখানকার চিকিৎসকরা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। এদিন ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন বলেন, আমার রোগীর শুরুতে টানা ৩-৪ দিন জ্বর ছিল। এরপর ইবনে সিনা মেডিকেলে পরীক্ষা করানোর পর সেখানে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। তখন তার প্লাটিলেট ছিল এক লাখ ২২ হাজার। তারপর আরও দুই দিন বাসায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরে হঠাৎ করেই জ্বরের সঙ্গে বমি-পাতলা পায়খানা শুরু হয়। একপর্যায়ে শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাওয়ায় দ্রুত এখানে নিয়ে আসি। এখন আমার রোগী আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো। তিনি বলেন, নতুন করে আবার ডাক্তার পরীক্ষা দিয়েছে, পরীক্ষা করে দেখি কী অবস্থা। যদি দেখি অবস্থা ভালো, তাহলে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাব।
কর্তব্যরত এক চিকিৎসকের কাছে এ বছর ডেঙ্গু রোগীদের উপসর্গ কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্যান্য সময়ের মতোই এবারের উপসর্গ হলো, প্রচুর জ্বর। যা টানা ৩-৪ দিন থাকছে। এরপরই ডেঞ্জার পিরিয়ডে চলে যাচ্ছে। তখন শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, ইন্টার্নাল ব্লিডিং শুরু হয়, নারীদের ক্ষেত্রে মাসিকের রাস্তা দিয়ে ব্লিডিং হয়। সেই সঙ্গে বমি, পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানা দেখা যায়। এসব রোগীদের নিয়ে পরীক্ষা করলেই ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে। এমনকি ওই অবস্থায় অনেকের প্লাটিলেট ১০-২০ হাজারেও নেমে যায়। তাই জ¦র হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলেন তিনি।

