ঢাকা শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৫

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক

হাসিনাকে ফেরাতে সরকার আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৫, ০১:০৮ এএম
  • সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন
  • জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে গণভোট আইন শিগগির
  • মানব পাচার এবং অভিবাসী চোরাচালান প্রতিরোধ ও দমন অধ্যাদেশ খসড়ার নীতিগত অনুমোদন

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফেরত চেয়ে ভারতকে চিঠি দেওয়া ছাড়াও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। আইন উপদেষ্টা এ সময় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন প্রসঙ্গেও সাংবাদিকদের জানান। এ ছাড়া জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে যে গণভোট হবে, সে বিষয়ে তিন-চার দিনের মধ্যে আইন করে ফেলার তথ্য দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে মানব পাচার এবং অভিবাসী চোরাচালান প্রতিরোধ ও দমন অধ্যাদেশের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। এর আগে গতকাল সকালে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে ফেরত প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে ফেরানোর জন্য ভারতকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে সাজাপ্রাপ্ত এই ব্যক্তিদের দেশে ফেরানোর জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে কোনো রকম অ্যাপ্রোচ করা যায় কি না, সেটা বিচার-বিবেচনা করার জন্য অচিরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা এখন সাজাপ্রাপ্ত, কাজেই সরকার মনে করে ভারতের এখন বাড়তি দায়িত্ব রয়েছে তাদের ফেরত দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশের মানুষের বিচারের আকাক্সক্ষা পূরণ করার জন্য ভারত যেন প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী তার দায়িত্ব পালন করে, সেটি স্মরণ করিয়ে ভারতকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামালকে ফেরত আনতে ইতালির রোমে স্থাপিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছে সরকার।’

এ সময় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইন চূড়ান্ত অনুমোদন প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইন চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে। আজ (গতকাল) আমরা মাজদার হোসেনের মামলার যে রায় ছিল, সেটির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠার শেষ ধাপ সম্পন্ন করলাম।

আইন উপদেষ্টা বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ হোকÑ এই আকাক্সক্ষা বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের মনে গত ২০-৩০ বছর যাবৎ রয়েছে। এটা নিয়ে আলোচিত হচ্ছে, অনেক পলিটিক্যাল পার্টি অনেক আশ্বাস দিয়েছে, অনেক কিছু বলেছে। আলটিমেটলি আমরা এখন একটা ভালো জায়গায় আসতে পেরেছি। সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এটা আমাদের বিচারীয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ছিল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ছিল। সেখানে এই প্রস্তাবে ঐকমত্য কমিশনের অংশগ্রহণকারী, আলোচনায় অংশগ্রহণকারী সব দল সম্মত হয়েছে। সব দল এটায় একমত যে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য সুপ্রিম কোর্টের একটা পৃথক সচিবালয় রাখবে, পৃথক সচিবালয়ের একটা আইনের নীতিগত অনুমোদনের জন্য এর আগে আমরা একটা উপদেষ্টা মিটিং করেছিলাম।

তিনি বলেন, নি¤œ আদালতের যে কন্ট্রোল বা শৃঙ্খলা কন্ট্রোল এবং শৃঙ্খলা বর্তমানÑ সংবিধান অনুযায়ী এটা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত মানে হলো, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে করেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আইন মন্ত্রণালয় কাজটা করে। প্রায়োগিকভাবে নি¤œ আদালতে বিচারকদের যে শৃঙ্খলা এবং কন্ট্রোলের যে বিধানগুলা, সেটা নি¤œ আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয় করে থাকে। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে এই অধ্যাদেশ কার্যকর হওয়ার পর নি¤œ আদালতের বিচারক কন্ট্রোল বলতে বোঝায় নি¤œ আদালতের বিচারকদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলাজনিত বিষয়াদি, ছুটিসংক্রান্ত বিষয়াদি, এমনকি নি¤œ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণ, সবকিছু সুপ্রিম কোর্টের সচিবালয় করবে। আইন মন্ত্রণালয় যেটা করত, এটা সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের সচিবালয়ের হাতে চলে যাবে।

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার আমলে নি¤œ আদালতে যারা বিচারক থাকতেন, তাদের আইন মন্ত্রণালয় কন্ট্রোল করত বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, আইন মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছায় নি¤œ আদালতের বিচারকেরা জামিন দেবেন কি দেবেন না, সাজা দেবেন কি দেবেন নাÑ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতেন। এমন অনেক অভিযোগ আমরা শুনতাম। এমন অনেক কিছু আমরা দেখতাম। এই অবস্থার অবসান ঘটবে। এই অধ্যাদেশ পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হওয়ার পর নি¤œ আদালতের বিচারকদের ওপর আইন মন্ত্রণালয় তথা সরকারের আর কোনো কন্ট্রোল থাকবে না। সম্পূর্ণভাবে এটা উচ্চ আদালত তার সচিবালয়ের মাধ্যমে বিষয়গুলো দেখাশোনা করবে।

এ সময় জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে যে গণভোট হবে, সে বিষয়ে তিন-চার দিনের মধ্যে আইন করে ফেলার তথ্য দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

তিনি বলেন, ‘গণভোট আইন আমরা খুব দ্রুত করতে যাচ্ছি। এই সপ্তাহে করে ফেলব। ধরেন, আজ কী বার, বৃহস্পতিবার তো? ধরেন আগামী তিন-চার কার্যদিবসের মধ্যে হয়ে যাবে।’

এদিকে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে মানব পাচার, অভিবাসী চোরাচালান প্রতিরোধ ও দমন অধ্যাদেশের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

প্রেস সচিব জানান, সভায় ভূমি ব্যবহার, নিয়ন্ত্রণ ও কৃষিভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ খসড়া চূড়ান্ত ও নীতিগত অনুমোদন হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আজ (গতকাল) টেলিযোগাযোগ সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হয়েছিল, কিন্তু আরও আলোচনার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

প্রেস সচিব জানান, ‘এ ছাড়া আমদানিনীতি নিয়ে আলাপ হয়েছে সভায়, সেটি আরও অধিকতর আলোচনার জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি জুলাই গণভ্যুত্থানের সময় সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ফেরত পাঠানো ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীদের বিষয়ে আলাপ হয়েছে। এটা নিয়েও আরও আলোচনা হবে।’

উপদেষ্টা পরিষদে মোট ২৫১টি সারসংক্ষেপ উপস্থাপিত হয়েছে এবং আলোচনা হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ৩৯৪টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে গত বছরের ৮ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত উপদেষ্টা পরিষদের সর্বমোট ৫১টি বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে বাস্তবায়নযোগ্য সর্বমোট ৩৯৪টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তন্মধ্যে ৩২২টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে, যা মোট গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের ৮২ শতাংশ। আর অবশিষ্ট ৭২টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে রয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বক্তব্যের বরাত দিয়ে প্রেস সচিব জানান, এত অল্প সময়ে এত বিপুলসংখ্যক সিদ্ধান্ত নেওয়া একটা নতুন রেকর্ড। বিগত ৫৪ বছরে অতীতের কোনো সরকার এত অল্প সময়ে এত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারেনি।