পিলখানা হত্যাযজ্ঞের তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর থেকে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের শীর্ষ মহলে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উল্লিখিত ঘটনার পেছনে পুলিশ ও র্যাব এবং রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও রয়েছে চরম ব্যর্থতা। ওই সময় পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) দায়িত্বে থাকা বর্তমানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমকেও এ ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। আলোচিত এ ঘটনায় অভিযুক্ত একজন ব্যক্তিকে পুলিশের শীর্ষ পদে বহাল রাখাটা কতটা যৌক্তিক, সেটা নিয়েই শুরু হয়েছে তোলপাড়।
গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র থেকে বিরাজমান এই পরিস্থিতির কথা জানা গেছে। সূত্র মতে, যে কোনো মুহূর্তে আইজিপি পদ থেকে তাকে সরিয়ে দিয়ে আইনের আওতায় আনা হতে পারে। বাহারুলের এক মেয়েও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তাকেও সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। কারণ পিলখানা হত্যাকা- তদন্তে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে আইজিপি বাহারুলের বিরুদ্ধে গুরুতর মন্তব্য এসেছে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এদিকে বিদ্রোহের নামে পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে দায়ীদের তালিকায় নাম আসায় আইজিপি বাহারুল আলমকে অপসারণ ও তার বিচারের দাবিতে গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে ‘শহিদ পিন্টু স্মৃতি সংসদ’ নামের একটি সংগঠন। অন্যদিকে আইজিপির অপসারণে সরকারকে আইনি নোটিশ দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী এ নোটিশ পাঠান। তারা হলেন- অ্যাডভোকেট মো. আব্দুস সামাদ, অ্যাডভোকেট শাহিন হোসেন ও অ্যাডভোকেট মো. আতিকুর রহমান।
২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকা-ের সময় বাহারুল আলম ছিলেন এসবিপ্রধান। বাহারুল বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। পিলখানার ঘটনার পরপরই তাকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে পাঠানো হয়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘ সদর দপ্তরের শান্তিরক্ষা বিভাগে পুলিশ লিয়াজোঁ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের সিনিয়র পুলিশ অ্যাডভাইজর হিসেবে কাজ করেন। ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, কসোভো ও সিয়েরা লিওনেও দায়িত্ব পালন করেন বাহারুল আলম। ২০২০ সালে তিনি অবসরে যান।
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০ নভেম্বর তাকে চুক্তিভিত্তিক আইজিপি করা হয়। পিলখানা হত্যাকা- তদন্তে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের ১৪৬ নম্বর পয়েন্টে পুলিশের পাঁচজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম এসেছে। অন্যরা হচ্ছেনÑ তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদ, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার নাইম আহমেদ, সাবেক (পলাতক) অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম, বিডিআর হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি আব্দুল কাহার আকন্দ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র মতে, প্রতিবেদনে বাহারুলের নাম আসাতে একটা বিব্রতকর অবস্থা দেখা দিয়েছে। পদস্থ পর্যায়ে আলোচনা চলছে পরবর্তী করণীয় নিয়ে। একটি মহল বলছে, তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আরেকটি মহল বলছে, আইজিপি পদ থেকে তাকে সরিয়ে কোথাও রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তবে, এই পক্ষের সংখ্যা খুবই কম। তবে সিদ্ধান্ত যেটাই হোক, মন্ত্রণালয় ভাবছে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব এটি কার্যকর করতে। এ বিষয়ে শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে একাধিক সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেছে।
মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল টেলিফোনে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কমিশনের একটি স্পর্শকাতর প্রতিবেদনে আইজিপির নাম আসার পর থেকেই প্রশাসনের ভেতরে আলোচনা-সমালোচনা এবং তোলপাড় শুরু হয়েছে। প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখা এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সক্রিয় থাকার অভিযোগ উঠে এসেছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছেÑ এমন বিতর্কিত অতীত থাকা একজন কর্মকর্তাকে জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা কতটা যৌক্তিক।
এ ছাড়া অবসরে চলে যাওয়া একজন ব্যক্তিকে আবার আইজিপি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সময়ই অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। অনেকেই সে সময় বলেছেন, বিভাগে কি কোনো দক্ষ কর্মকর্তা নেই যে একজন অবসরে চলে যাওয়া ব্যক্তিকে আবার বহাল করতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে তখন এই প্রশ্নটি জোরালোভাবে দানা বাঁধতে পারেনি।
তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তৎকালীন অতিরিক্ত আইজিপি (এসবিপ্রধান) বাহারুল আলম, কমিশনকে অনুমাননির্ভর তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিরোধী দলের কর্মীদের ফাঁসিয়েছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পিলখানা হত্যাকা-ের ঘটনায় বিএনপি নেতা নাসিরুদ্দিন পিন্টুকে জড়িয়ে ছিলেন আইজিপি বাহারুল আলম। পিলখানার ঘটনার দিন জাহাঙ্গীর কবির নানক ও তাপসের লোকজন বিডিআরের পক্ষে মিছিল করে। সেই মিছিলে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীর ছেলে লেদার লিটন। অথচ ওই মিছিলটি নাসিরুদ্দিন পিন্টুর লোকজন করেছে বলে বাহারুল আলম তদন্ত কমিটিকে বলেন। সে সময় নাসিরুদ্দিন পিন্টুকে গ্রেপ্তারও করা হয় এবং পরবর্তীতে কারাগারে মারা যান তিনি। আনোয়ার হোসেন মাহবুব নামে পিন্টু মুক্তি পরিষদের আরেক নেতাও (লালবাগ ভাট মসজিদ এলাকার) এর কয়েকদিন পর গ্রেপ্তার হন। পিন্টু এবং মাহবুব দুজনই কারারুদ্ধ অবস্থায় মারা যান।
কর্মকর্তা আরও জানান, বাহারুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, কমিশনের তদন্তে অনুমানভিত্তিক তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ঘটনায় সরকার বিরোধীদের ফাঁসানো, মিছিলকারীদের শনাক্ত না করে বিরোধীদলীয় কর্মীদের ওপর দায় চাপানো, মিছিলকারীদের শনাক্ত না করা, এসবির তৎকালীন মাঠপর্যায়ের টিমের পরিচয় না জানিয়ে এবং ওই টিম কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যপ্রমাণ কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী প্রদান না করে কমিশনকে অসহযোগিতা করা।
স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান গত রোববার সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তে পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম এসেছে। তাদের মধ্যে আছেন বর্তমান আইজিপি বাহারুল আলমও। কেন তার নাম এসেছেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণেই তার নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ জাতির সামনে প্রকাশ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করার।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘কমিশন তাদের কাজ করেছে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কী সিদ্ধান্ত হবে, তা সরকারের এখতিয়ার। এ নিয়ে আমার বলার কিছু নেই।’
এদিকে সচিবালয়ে বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘মন্ত্রণালয় বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। প্রতিবেদনটি বড়, সব পড়া হয়নি। পুরো প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে তাদের সুপারিশগুলো অবশ্যই বাস্তবায়ন করা হবে।’
গত রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির পিলখানা হত্যাযজ্ঞে বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৮ জন সেনাসদস্যসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের মামলায় ১৩৯ জনকে মৃত্যুদ- এবং ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ দেন আদালত। আরও অন্তত ২২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। তবে ঘটনার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন তুলে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন ভুক্তভোগীরা।
ঘটনার দেড় দশক এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর সাত সদস্যের জাতীয় স্বাধীন কমিশন গঠন করে সরকার। তদন্ত কমিশন গত ৩০ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
আইজিপিকে অপসারণ ও বিচারের দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি
পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে নারকীয় হত্যাকা-ের ঘটনায় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে দায়ীদের তালিকায় নাম আসায় আইজিপি বাহারুল আলমকে অপসারণ ও তার বিচারের দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে ‘শহিদ পিন্টু স্মৃতি সংসদ’ নামের একটি সংগঠন। সংগঠনের সভাপতি ফরহাদ আহমেদ ডলার ও সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির সেলিম স্বাক্ষরিত স্মারকলিপিটি গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়।
জানা গেছে, পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর হত্যাকা-ের পর বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য (ঢাকা-৮) নাসিরুদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে তিনি কারাগারে মারা যান। এক সময়ের প্রভাবশালী এই রাজনীতিবিদের স্মরণে ‘শহিদ পিন্টু স্মৃতি সংসদ’ দীর্ঘদিন ধরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গতকাল বিকেল ৩টায় ‘শহিদ পিন্টু স্মৃতি সংসদের’ ব্যানারে পলাশী মোড় থেকে তিন শতাধিক মানুষ একটি মিছিল শুরু করেন। সাবেক বিএনপি নেতা পিন্টুর হত্যার বিচারের দাবিতে আয়োজিত এই মিছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে রওনা হয়। মিছিলকারীরা আইজিপি বাহারুল আলমকে অভিযুক্ত করে স্লোগান দেনÑ ‘আইজিপি বাহারুলের ফাঁসি চাই, বিচার চাই’। সংগঠনের নেতারা জানান, তারা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পিন্টু হত্যার বিচার দ্রুত সম্পন্নের দাবিতে স্মারকলিপি দেন।
আইজিপি বাহারুল আলমকে সরিয়ে দিতে লিগ্যাল নোটিশ : বিডিআর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে দায়ীদের তালিকায় নাম আসায় আইজিপি বাহারুল আলমকে অপসারণ করতে সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এ নোটিশ পাঠানো হয়। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী এ নোটিশ পাঠান। নোটিশ পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাহারুল আলমকে অপসারণ করতে বলা হয়েছে, না হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন