ঢাকা শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৫

বাংলাদেশের মাইমুনা দুবাইয়ের সফল সাইবার নিরাপত্তা পেশাজীবী

মাহমুদুল হাসান
প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২৫, ০৮:৩৮ এএম

বাংলাদেশের ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের মেয়ে মাইমুনা আক্তার লিজা এখন দুবাইয়ের সফল একজন সাইবার নিরাপত্তা পেশাজীবী। ‘রিনিউয়াল ম্যানেজার’ হিসেবে মাইমুনা বর্তমানে কাজ করছেন গালফ তথা উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম সাইবার নিরাপত্তা সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গালফ আইটি নেটওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিউশনে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ১০ জনের একটি দলকে নেতৃত্বও দিচ্ছেন মাইমুনা। এই তরুণী পেশাজীবীর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি গালফ আইটি নেটওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিউটর মাইমুনাকে ‘লিডারশিপ এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’ এ ভূষিত করেন। মাইমুনাকে নিয়ে বিশেষ ফিচার প্রকাশ করে দুবাইভিত্তিক সাময়িকী ‘দ্যা দুবাই লিডারস’। প্রযুক্তি নিয়ে আনুষ্ঠানিক পড়াশুনা না করলেও, উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশকিছু বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সাইবার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখভাল করেন মাইমুনা। বিজনেস গ্র্যাজুয়েট মাইমুনা নিজের প্রবল আগ্রহ ও ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করে সফল ক্যারিয়ার গড়েছেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং খাত সাইবার নিরাপত্তা ইন্ডাস্ট্রিতে।

ব্যবসা শিক্ষার শিক্ষার্থী থেকে সাইবার নিরাপত্তায় প্রবেশ

মাইমুনার স্কুল ও কলেজ পেরোয় দুবাইতেই। খুব ছোট থাকবে বাবা আবদুল হালিম এবং লুতফুন নাহারের হাত ধরে ২০০৩ সালে দুবাই পাড়ি জমান মাইমুনা। দুবাইয়ের অন্যতম শীর্ষ বিজনেস স্কুল ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট টেকনোলজি থেকে স্নাতক এবং সুইস স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। মাইমুনার ক্যারিয়ারের শুরুটা হয় রিয়েল এস্টেট খাতে। স্থানীয় একটি স্বনামধন্য রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানে ‘রিয়েলেটর’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ক্যারিয়ার হয় মাইমুনার। সেখান থেকে অনেকটা আকস্মিকভাবেই পুরুষ-নেতৃত্বাধীন প্রযুক্তি খাতে কাজ শুরু করেন তিনি। রিয়েল এস্টেট খাতে নিয়োজিত থাকাকালীন এক গ্রাহকের মাধ্যমে প্রযুক্তি খাতে প্রবেশ ঘটে মাইমুনার। মাইমুনার কাজের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানের রিনিউয়াল বিভাগে যোগ দিতে মাইমুনাকে প্রস্তাব দেন সেই গ্রাহক।

নিজের কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে মাইমুনা বলেন, আমি সাইবার সিকিউরিটি স্পেশালিস্ট বা বিশেষজ্ঞ না বরং সাইবার নিরাপত্তা সেবাপ্রদানকারী হিসেবে আমার প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহকদের মাঝে সমন্বয়কের কাজ করি। ‘অপারেশন্স হ্যান্ডলিং’ এর মাধ্যমে আমার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখি। আর আমাদের ব্যবসা বি-টু-বি (বিজনেস টু বিজনেস) ধরনের ফলে অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের গ্রাহক। যেমন আমি এবং আমার টিম সৌদি এরামকো, সৌদি টেলিকম, কাতার ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংকের মতো গ্রাহকদের দেখভাল করি”।

সাইবার নিরাপত্তা খাতের পরিণত পেশাজীবী

উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে ২০টিরও বেশি সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সাইবার নিরাপত্তা সেবা প্রদান করে গালফ আইটি নেটওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিউশন। প্রতিষ্ঠানটির রিনিউয়াল বিভাগে যোগ দেওয়ার পর থেকে মাইমুনা এর প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। তাঁর নেতৃত্বে শুধু জনবল বৃদ্ধি পায়নি, বরং বাজারে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে। মায়মুনা পার্টনার ও ক্লায়েন্টের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেন, যা প্রতিষ্ঠানটির উচ্চ রিনিউয়াল হার ও গ্রাহক সন্তুষ্টি নিশ্চিত করে। প্রতিষ্ঠানটিতে নিজের কাজের পরিধি তুলে ধরে মাইমুনা বলেন, “গালফ আইটি নেটওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিউশনে আমি পুরো জিসিসি অঞ্চলের (কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, সৌদি আরব) সাইবার নিরাপত্তা সমাধানের রিনিউয়াল কার্যক্রম তদারকি করি। যেহেতু অধিকাংশ নিরাপত্তা সমাধান এখন ক্লাউড-ভিত্তিক, তাই আমার প্রধান দায়িত্ব হলো লাইসেন্স নবায়ন নিশ্চিত করা, যাতে ব্যবসাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে। এই বিষয়টিই আমি ও আমার টিম মিলে দেখভাল করি”।

রিয়েল এস্টেট থেকে সাইবার নিরাপত্তায় আসার চ্যালেঞ্জ

রিয়েল এস্টেট থেকে সাইবার নিরাপত্তায় ক্যারিয়ারের রূপান্তর করা মোটেও সহজ ছিল না মাইমুনার জন্য। বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি বা সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ডিগ্রিও নেই তার। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্পর্কে মাইমুনা বলেন, “টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকায় শুরুতে জটিল সফটওয়্যার, ক্লাউড-ভিত্তিক সমাধান ও লাইসেন্সিং মডেল বোঝা কঠিন ছিল।

কিন্তু হার মানিনি। প্রশিক্ষণ, কনফারেন্সে অংশগ্রহণ, অনলাইন কোর্স অধ্যায়ন এবং প্রযুক্তি দলগুলোর সঙ্গে নিবিড় কাজের মাধ্যমে বিষয়গুলো দ্রুত আয়ত্ত করি”। তাছাড়া, পুরুষ-নেতৃত্বাধীন প্রযুক্তি জগতে নারী হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরিও বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল তার জন্য। ব্যবসায়িক প্রজ্ঞা, কৌশলগত চিন্তা এবং নেটওয়ার্কিং তথা যোগাযোগ গড়ে তোলার দক্ষতা প্রতিষ্ঠানে আস্থা ও নেতৃত্বস্থানীয় পদ অর্জনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন মাইমুনা। আজ তিনি দশজনের একটি দল পরিচালনা করছেন এবং আফ্রিকান বাজারেও কোম্পানির কার্যক্রম সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছেন।

সাইবার নিরাপত্তায় ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী তরুণদের প্রতি

মায়মুনা বিশ্বাস করেন, নতুন খাতে প্রবেশ করতে হলে কৌতূহল, দৃঢ়তা ও নিরবচ্ছিন্ন শেখার মনোভাব অপরিহার্য। তাঁর মতে, সাইবার নিরাপত্তায় কাজ করতে সবসময় প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকা জরুরি নয়। বিক্রয়, রিনিউয়াল বা ব্যবসা উন্নয়নমূলক অনেক কাজে ব্যবসায়িক বোধই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তিনি নেটওয়ার্কিংয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। মাইমুনা বলেন, আমার নিজের যাত্রাই শুরু হয়েছিল গ্রাহকের সঙ্গে এক পরিচয়ের মাধ্যমে। তাই আমি অন্যদের পরামর্শ দেবো যেন তারা যেখাতে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী সেই খাত সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নেন, অভিজ্ঞদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন এবং মেন্টরশিপ খুঁজে নেন।

এছাড়া মাইমুনা মনে করেন, প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সাইবার নিরাপত্তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে নিজেকে আপডেটেড রাখা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস; এগুলোই নতুন খাতে সফলতার মূল চাবিকাঠি। বিশেষ করে নারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, ধৈর্য ধরে কাজ করতে হবে এবং প্রমাণ করতে হবে যে আপনিও সক্ষম। কোথা থেকে শুরু করছেন, সাফল্য তার ওপর নির্ভর করে না; বরং সাফল্য নির্ভর করে কিভাবে নিজেকে পরিবর্তন করছেন এবং বেড়ে উঠছেন, তার ওপর।”