আজকের ডিজিটাল পৃথিবীতে আমাদের দৈনন্দিন জীবন প্রায় পুরোপুরি ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। ব্যাংকিং, কেনাকাটা, অফিসের কাজ, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা বিনোদনÑসবকিছুই এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মভিত্তিক। এই নির্ভরতা যত বাড়ছে, ততই বেড়ে যাচ্ছে সাইবার হামলার ঝুঁকি। ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট হ্যাক থেকে শুরু করে বড় প্রতিষ্ঠানের ডেটা চুরি আমাদের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাই হ্যাকিং বা সাইবার আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে হলে প্রয়োজন কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
শক্তিশালী পাসওয়ার্ড এবং দুই-স্তরীয় প্রমাণীকরণ
হ্যাকিং প্রতিরোধের প্রথম এবং সবচেয়ে কার্যকরী ধাপ হলো শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার। অনেকেই সহজ অনুমেয় পাসওয়ার্ড যেমন ১২৩৪৫৬, জন্মতারিখ বা মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেন। এগুলো হ্যাকারদের কাছে সবচেয়ে সহজ টার্গেট। একটি নিরাপদ পাসওয়ার্ডে বড় হাতের অক্ষর, ছোট হাতের অক্ষর, সংখ্যা এবং বিশেষ চিহ্ন থাকা উচিত এবং সেটি অন্তত ১০-১২ অক্ষরের হওয়া জরুরি। এ ছাড়া একই পাসওয়ার্ড একাধিক অ্যাকাউন্টে ব্যবহার করাও বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে। একটি অ্যাকাউন্ট হ্যাক হলে অন্য সবগুলোও হুমকির মুখে পড়ে। তাই প্রতিটি অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ। শুধু পাসওয়ার্ড যথেষ্ট নয়, এর পাশাপাশি টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন ব্যবহার করা উচিত। এতে লগইন করার সময় পাসওয়ার্ডের পাশাপাশি ফোনে আসা কোড বা অথেনটিকেশন অ্যাপ থেকে পাওয়া টোকেন দিতে হয়। যেমন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপে ওটিপি বা অ্যাপভিত্তিক অথেন্টিকেশন ব্যবহার করলে অ্যাকাউন্ট অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকে।
নিয়মিত আপডেট ও প্যাচ ইনস্টল
সাইবার হামলার অন্যতম পথ হলো পুরোনো সফটওয়্যারের দুর্বলতা। হ্যাকাররা প্রায়ই অপ্রচলিত বা আপডেটবিহীন সিস্টেমকে টার্গেট করে। উইন্ডোজ, লিনাক্স, ম্যাকওএস বা মোবাইল অ্যাপের প্রতিটি আপডেটে শুধু নতুন ফিচার নয়, গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ফিক্সও যুক্ত থাকে। কিন্তু অনেক ব্যবহারকারী এই আপডেটগুলো উপেক্ষা করেন বা পরে করার জন্য রেখে দেন। এর ফলে সিস্টেম দুর্বল থেকে যায় এবং হ্যাকারদের প্রবেশ সহজ হয়ে পড়ে। তাই নিয়মিত আপডেট এবং সিকিউরিটি প্যাচ ইনস্টল করা জরুরি। একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যার, প্লাগইন বা অ্যাপ মুছে ফেলা উচিত, কারণ এগুলোও আক্রমণের দরজা খুলে দিতে পারে।
নিরাপদ নেটওয়ার্ক ব্যবহার
পাবলিক ওয়াই-ফাই অনেক সময় হ্যাকারদের জন্য সবচেয়ে সহজ প্রবেশপথ হয়ে ওঠে। কফিশপ, রেস্টুরেন্ট বা বিমানবন্দরে ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহার করার সময় ব্যবহারকারীরা প্রায়শই ব্যাংকিং বা গোপন তথ্য আদান-প্রদান করেন। এ ধরনের নেটওয়ার্কে তথ্য সহজেই চুরি হতে পারে। এই ঝুঁকি থেকে বাঁচতে ভিপিএন বা ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা উচিত। ভিপিএন ব্যবহার করলে ইন্টারনেট ট্রাফিক এনক্রিপ্টেড হয়, ফলে হ্যাকারদের পক্ষে ডেটা পড়া কঠিন হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠান বা বড় সংস্থার ক্ষেত্রে আরও উন্নত ব্যবস্থা নিতে হয়। ফায়ারওয়াল, ইন্ট্রুশন ডিটেকশন সিস্টেম (ওউঝ) এবং নেটওয়ার্ক মনিটরিং সফটওয়্যার ব্যবহার করলে সন্দেহজনক কার্যকলাপ আগেভাগেই শনাক্ত করে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ইথিক্যাল হ্যাকিংয়ের জ্ঞান ও সচেতনতা
প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা যতই উন্নত হোক না কেন, ব্যবহারকারীর সচেতনতা না থাকলে ঝুঁকি থেকেই যায়। হ্যাকাররা অনেক সময় সরাসরি সফটওয়্যার আক্রমণ না করে ব্যবহারকারীর ভুল বা অবহেলাকে কাজে লাগায়। যেমন ফিশিং ইমেইল, সন্দেহজনক ওয়েবসাইটের লিংক, বা ম্যালওয়্যার যুক্ত অ্যাটাচমেন্টে ক্লিক করলেই অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে যেতে পারে। এই ঝুঁকি কমাতে ইথিক্যাল হ্যাকিং বা মৌলিক নিরাপত্তা পরীক্ষার (পেন-টেস্ট) সামান্য ধারণা থাকলে উপকার পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি ওয়েবসাইটে অননুমোদিত লগইন প্রচেষ্টা হচ্ছে কিনা বা সার্ভারে নিরাপত্তা দুর্বলতা আছে কিনা, তা সহজেই শনাক্ত করা যায়। প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত সাইবার সিকিউরিটি ট্রেনিং দিলে কর্মীরা সচেতন হয় এবং হ্যাকারদের ফাঁদে পা দেওয়ার সম্ভাবনা কমে।
ব্যাকআপ ও নিরাপদ ডেটা সংরক্ষণ
সাইবার আক্রমণের ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় ডেটা হারানোর মাধ্যমে। র্যানসমওয়্যার আক্রমণের সময় হ্যাকাররা ব্যবহারকারীর ডেটা লক করে দেয় এবং মুক্তিপণ দাবি করে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিয়মিত ব্যাকআপ নেওয়ার বিকল্প নেই। ব্যাকআপ ক্লাউডে অথবা এক্সটার্নাল হার্ডড্রাইভে রাখা যেতে পারে। তবে ব্যাকআপ সিস্টেমও সুরক্ষিত হতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল তথ্য অবশ্যই এনক্রিপ্টেড ফাইল ফরম্যাটে সংরক্ষণ করা উচিত, যাতে হ্যাকাররা চুরি করলেও তা ব্যবহার করতে না পারে।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তানীতি
শুধু ব্যক্তি নয়, বড় বড় প্রতিষ্ঠানও হ্যাকিংয়ের বড় শিকার। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আলাদা সাইবার নিরাপত্তা নীতি থাকা জরুরি। কর্মীদের তথ্য অ্যাক্সেস সীমিত রাখা, নিয়মিত নিরাপত্তা অডিট করা এবং শক্তিশালী সার্ভার সুরক্ষাব্যবস্থা রাখা উচিত। এ ছাড়া কর্মীদের দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় কর্মীদের অসচেতনতার কারণে ফিশিং ইমেইল থেকে পুরো সিস্টেম আক্রান্ত হয়। তাই প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা ড্রিল এবং ব্যবহার নির্দেশিকা সবার জানা থাকা অপরিহার্য।
জাতীয় ও বৈশ্বিক উদ্যোগ
সাইবার আক্রমণ এখন আর কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একটি দেশের হ্যাকার অন্য দেশের ব্যাংক, সরকারি ডেটাবেইস বা সামরিক অবকাঠামোতেও হামলা চালাতে পারে। তাই জাতীয় পর্যায়ে শক্তিশালী আইন, সাইবার নিরাপত্তা কেন্দ্র এবং জরুরি প্রতিক্রিয়া দল (ঈঊজঞ) থাকা অপরিহার্য। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য বিনিময়, যৌথ গবেষণা এবং অপরাধীদের আইনি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বৈশ্বিক সমঝোতা দরকার। উন্নত প্রযুক্তি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন এবং মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী করা যেতে পারে। ডিজিটাল যুগে হ্যাকিং থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা সম্ভব নয়, তবে এ ধরনের সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন