জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০তম অধিবেশনে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাশাপাশি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে নাগরিকবান্ধব সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি গতকাল শুক্রবার নিউইয়র্কে বেলা ১১টায় এ ভাষণ দেন।
তিনি বলেন, শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম, নারী অধিকারসহ সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার জন্য আমরা ১১টি স্বাধীন সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। কমিশনগুলো জনমত যাচাই ও গভীর পর্যালোচনা করে বিস্তারিত সংস্কার কার্যক্রম সুপারিশ করেছে। এ সংস্কার সুপারিশগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়নের জন্য আমরা একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছি, যারা ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটকে নিয়ে আলোচনায় বসেছে। এ কমিশনের লক্ষ্য ছিল সংস্কার প্রস্তাবগুলোর প্রতি দল-মত-নির্বিশেষে একটি টেকসই সামাজিক অঙ্গীকার তৈরি করা। আমাদের এই অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ সফল হয়। আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে সকলে মিলে ‘জুলাই ঘোষণা’র মাধ্যমে এই সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি আমাদের সময়াবদ্ধ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছি। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে যেই দলই জনগণের সমর্থন পাক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না।
প্রধান উপদেষ্টা দিনের দশম বক্তা হিসেবে ভাষণ দেন। এ সময় তিনি তার ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম, ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার, জুলাই হত্যাকা-ের বিচার এবং রোহিঙ্গা সংকটের বিষয় তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে জানান, অধ্যাপক ইউনূস গত ১৪ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম এবং দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অগ্রগতি সম্পর্কে বিশ্ব সম্প্রদায়কে জানাবেন। তিনি আরও বলেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করতে সরকারের নেওয়া উদ্যোগও ভাষণে গুরুত্ব পাবে।
প্রেস সচিবের ভাষায়, মূল বার্তাটি হবে-বিশ্ববাসীর কাছে প্রধান উপদেষ্টা তুলে ধরবেন আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনটি হবে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য এবং উৎসবমুখর।
উচ্চপর্যায়ের নৈশভোজে অংশগ্রহণ: জাতিসংঘে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন আয়োজিত এক উচ্চপর্যায়ের নৈশভোজে শ্রম আইন, শ্রমিকের অধিকার ও চলমান সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন কূটনীতিক, জাতিসংঘ কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা আলোচনায় অংশ নিয়ে শ্রম খাত সংস্কার অব্যাহত রাখার প্রতি ঐকমত্য প্রকাশ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস তার বক্তব্যে বলেন, বৃহৎ পরিসরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য শ্রম সংস্কার অপরিহার্য। তিনি ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আইএলও মহাপরিচালক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তারা শ্রম খাত সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির উন্নতির সম্ভাবনা তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের আগে রাজনৈতিক নেতাদের সংক্ষিপ্ত মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পোশাকশিল্পকে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ উল্লেখ করে বলেন, ভবিষ্যৎ সরকার যেই হোক, খাতটির প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতেই হবে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, তাদের দলের অনেক নেতার সরাসরি অভিজ্ঞতা রয়েছে পোশাকশিল্পে কাজ করার। এ অভিজ্ঞতা খাতটিকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আরও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে মূল্যবান দৃষ্টিভঙ্গি দেন। তিনি সরকারের সংস্কার পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়ে ভবিষ্যতে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা জানান।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবীর বলেন, বর্তমান সংস্কার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন।
তিন নেতার বক্তব্যেই অভিন্নভাবে উঠে আসে পোশাক রপ্তানিতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার দাবি। তাদের অভিমত, সব সময় ক্রেতাদের শর্তে নয়, বরং ন্যায্যতার ভিত্তিতে দাম নির্ধারিত হওয়া উচিত। এ বিষয়ে সর্বদলীয় সমর্থন দেখা যায়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময় মেডিকেল শিক্ষার্থী হিসেবে আহত ব্যক্তিদের সেবা দেন। তিনি বলেন, ‘সেই ঘটনাই আমার রাজনৈতিক চিন্তা গড়ে দিয়েছে। তিনি শ্রম নিরাপত্তার মানবিক দিক ও সংস্কারের জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।’
সমাপনী বক্তব্যে অধ্যাপক ইউনূস শ্রম খাত সংস্কারকে অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন ও শ্রমিকের কল্যাণে অপরিহার্য বলে জানান।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন