নানা কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্স পেতে যাচ্ছে ‘বাংলা ফোন’। অবশ্য একই লাইসেন্স চেয়ে ম্যাঙ্গো টেলিসার্ভিস লিমিটেডের আবেদন বাতিল করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেডের (বিটিসিএল) এনটিটিএন লাইসেন্স থাকায় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) আবেদন অধিকতর পর্যালোচনা করতে চায় কমিশন। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আর্মি ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (এটিসিএল) অনুকূলে এনটিটিএন লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে লাইসেন্স বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনা সিস্টেমে (এলআইএমএস) প্রতিষ্ঠানটির আবেদন প্রাপ্তিসাপেক্ষে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি।
অপরপক্ষে, এনটিটিএন রেগুলেটরি এবং লাইসেন্সিং গাইডলাইন অনুযায়ী যোগ্য না হলেও, বিবেচনায় রাখা হয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর (এমএনও) বাংলালিংকের মালিকানা প্রতিষ্ঠান ‘ভিওন’-এর আবেদন। সবমিলিয়ে, এনটিটিএন লাইসেন্স আবেদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার নজির স্থাপন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।
২০১১ সালের জুনে এনটিটিএন লাইসেন্স পেতে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করে বাংলা ফোন। লাইসেন্স না পেলেও, সে সময় বিটিআরসির এক বিতর্কিত ‘পারমিট’ নিয়ে ‘ওভার হেড ক্যাবল’ তথা ঝুলন্ত ক্যাবলের মাধ্যমে এনটিটিএন ব্যবসা করে আসছিল বাংলা ফোন। প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্যোক্তা আমেরিকা প্রবাসী ব্যবসায়ী আমজাদ খান। এনটিটিএন লাইসেন্স চেয়ে ২০১৬ সালে আদালতে গিয়েও বিফল হন তিনি।
তবে ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর লাইসেন্সের জন্য বিটিআরসিতে আবারও আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এতেও জটিলতা কাটছিল না প্রতিষ্ঠানটির। এলআইএমএস’র মাধ্যমে পুনরায় আবেদন করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সব দলিল যথাযথভাবে না থাকায়, সেগুলো হালনাগাদ করতে হয় বাংলা ফোনকে। বাংলা ফোনের নামে পূর্বে পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিন) লাইসেন্স ছিল এবং সেখানে বিটিআরসির ১ কোটি ৫৬ লাখ ২৬ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে।
এতকিছুর পরেও, শেষ পর্যন্ত বাংলা ফোনের অনুকূলে এনটিটিএন লাইসেন্স দিতে সম্মত হয় কমিশন। এ বিষয়ে পূর্বানুমোদন চেয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ বরাবর গত ২৫ মে চিঠিও দিয়েছে কমিশনের লাইসেন্সিং শাখা। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই বাংলা ফোনকে দেওয়া হবে এনটিটিএন লাইসেন্স।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়ে কিছু জানেন না উল্লেখ করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বাংলা ফোনের উদ্যোক্তা আমজাদ খান।
অন্যদিকে এনটিটিএন লাইসেন্স চেয়ে বাংলালিংকের মালিকানা প্রতিষ্ঠান ‘ভিওন’-এর আবেদন বিদ্যমান এনটিটিএন গাইডলাইনের অনুচ্ছেদ ৫.০৪ অনুযায়ী যোগ্য নয়। ওই অনুচ্ছেদ বলছে, মোবাইল ফোন অপারেটরের লাইসেন্স পাওয়া কোম্পানির অংশীদাররা এনটিটিএন লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবে না। সে হিসেবে ভিওনের এনটিটিএন লাইসেন্সের আবেদন বিবেচনা করা সমীচীন নয় বলেও কমিশনকে অবহিত করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
তবুও লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সংস্কার করে বিটিআরসির সুপারিশকৃত নীতিমালা, সরকারের অনুমোদন পাওয়ার প্রত্যাশায় ভিওনের এই আবেদনের বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
তবে গত ১৯ মে অনুষ্ঠিত বিটিআরসির একই কমিশন সভায়, ভিন্নরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ম্যাঙ্গো টেলিসার্ভিসেসের ক্ষেত্রে। জাতীয় পর্যায়ের ‘আইএসপি’ (ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাপ্রদানকারী) লাইসেন্স থাকায় ম্যাঙ্গোর আবেদন বিবেচনাই করেনি কমিশন। ২০১৮ সালের অক্টোবরে এই লাইসেন্স পায় ম্যাংগো। আইএসপি গাইডলাইনের অনুচ্ছেদ ৭.৩ অনুযায়ী, কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এনটিটিএন লাইসেন্স থাকলে, সে আইএসপি লাইসেন্স আবেদনের যোগ্য হবে না। অর্থাৎ অনুচ্ছেদটির বিপরীতমুখী প্রয়োগের মাধ্যমে ম্যাঙ্গোর এনটিটিএন লাইসেন্সের আবেদন খারিজ করে বিটিআরসি।
ইন্টারনেট খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনটিটিএন লাইসেন্স ইস্যুতে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে ভিওনকে। গাইডলাইনের সাথে তাদের আবেদন স্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক হলেও, বিবেচনায় রাখা হয়েছে ভিওনের আবেদন।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে, দেশে ইন্টারনেট সঞ্চালন ব্যবস্থার ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত এক উদ্যোক্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, একটি অনুচ্ছেদের বিপরীতমুখী প্রয়োগ করে ম্যাঙ্গোর আবেদন সরাসরি বাতিল করল কমিশন। কিন্তু ভিওনের আবেদন সরাসরি সাংঘর্ষিক হওয়ার পরেও, লাইসেন্সের শর্তে ভবিষ্যতে পরিবর্তন আসবে, এই আশায় তাদের আবেদন রেখে দেওয়া হলো।
এটা তো দ্বিচারিতা। ভবিষ্যতে লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলে, ভিওন নতুন আবেদন করবে, সমস্যা নাই তো? কিন্তু ভিওনের আবেদন বাতিল না করে রেখে দেওয়ার মাধ্যমে তাদেরকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হলো।
এ বিষয়ে বাংলালিংক এর চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিদ্যমান আইনে এনটিটিএন লাইসেন্স পাওয়ার কথা না, তবে লাইসেন্স ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন (সংস্কার) আসছে, সেখানে আমরা (ভিওন) পেতে পারি। গ্রুপ (ভিওন) থেকে অনুরোধ করা হচ্ছে (সরকারের কাছে) যে, আমরা যেন সবকিছু করতে পারি। কারণ ‘ভ্যালু চেইন’-এ থাকতে পারলে, গ্রাহকদের আরও ভালো সেবা দিতে পারব। বাংলালিংক বা ভিওন বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে, এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা কোনো বাড়তি সুবিধা পাচ্ছি না, অন্যরা পাচ্ছে।
এনটিটিএন লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেছে দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানও। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের আওতাধীন বিসিসির আবেদনে নিমরাজি অবস্থান বিটিআরসির। আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিসিএলের এনটিটিএন লাইসেন্স থাকায়, বিসিসির আবেদন অধিকতর পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। তবে এটিসিএলের আবেদন এলআইএমএস পোর্টালে প্রাপ্তি সাপেক্ষে পরবর্তী কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত দিয়েছে বিটিআরসি। খাত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পোর্টালে যথাযথ আবেদন জমা হলে, এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়া হবে প্রতিষ্ঠানটিকে।
এনটিটিএন লাইসেন্সের বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসির বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে চেয়ারম্যান বিদেশে থাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করতে রাজি হননি সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা এবং কমিশনাররা।
এদিকে নতুন এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়াতে ইন্টারনেট খাত সংশ্লিষ্টদের মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিতর্ক আছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়া নিয়েও। সাধারণ আইএসপি ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন দেশীয় এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান বাজারে আসলে, ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের পরিধি বাড়বে। ব্রডব্যান্ড সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির সাবেক সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, ‘নতুন প্রতিষ্ঠানকে এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই, তবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে না।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক বসানোর লাইসেন্স দেওয়া উচিত না। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই বিনিয়োগ এবং কারিগরিভাবে সক্ষম। ভারত (আগে ছিল), নেপাল এবং পাকিস্তানে সব টেলিকম লাইসেন্স স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়া উচিত। বিভাগীয় পর্যায়ের এনটিটিএন অপারেটরের দায়িত্ব থাকবে তার এলাকায় ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের পরিধি বাড়ানো।
অবশ্য বিদ্যমান এনটিটিএন অপারেটরদের দাবি, তারা নিজেরাই বিনিয়োগকৃত অর্থ উঠাতে পারছেন না। সেখানে নতুন এনটিটিএন অপারেটর ব্যবসা সফল হবে না। বেসরকারি এনটিটিএন অপারেটর বাহন লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা রাশেদ আমিন বিদ্যুত রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিদ্যমান এনটিটিএন অপারেটরদেরই টিকে থাকা মুশকিল হচ্ছে। আমরা যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছি, এটা উঠাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বাহনের ইতোমধ্যে প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক আছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নেটওয়ার্ক স্থাপনে একবার সড়ক খোঁড়া হয়েছে। নতুন অপারেটর এসে আবারও খোঁড়াখুঁড়ি করবে। এভাবে তো খরচ পোষাবে না। নতুন অপারেটরদের জন্য কিন্তু নতুন গ্রাহক নেই। এমএনও, আইআইজি, আইএসপি’দের সেবা দিচ্ছে বিদ্যমান এনটিটিএন’রা। তারাই আবার নতুন এনটিটিএনের গ্রাহক। এনটিটিএন বাড়লেও, এই খাতের গ্রাহক কিন্তু বাড়েনি। ফলে লাইসেন্স পেলেও, নতুনদের এখানে ব্যাবসায়িকভাবে সফল হওয়া দুরূহ।

 
                             
                                    

 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                    -20251031020255.webp) 
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
       -20251031190935.webp) 
        
        
        
        
        
        
       -20251031183405.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন