গাজায় অব্যাহত রয়েছে ইসরায়েলের হামলা। আবার অন্যদিকে ত্রাণ সহায়তা প্রবেশে বাধা। এই ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ায় তীব্র ক্ষুধায় ভুগছে গাজাবাসী। জাতিসংঘ গাজার এই পরিস্থিতিকে বিপর্যয়কর ক্ষুধা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। যা ক্ষুধার সর্বোচ্চ ধাপ হিসেবে পরিগণিত। জাতিসংঘের হিসাব মতে, গাজায় ২৩ লাখ মানুষ এই বিপর্যয়কর ক্ষুধায় ভুগছে। গতকাল শনিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরা। জাতিসংঘের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে খাদ্যসংকটপূর্ণ ও ক্ষুধার্ত এলাকা হলো গাজা উপত্যকা। তারা বলেছে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের সব লোক এখন দুর্ভিক্ষের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গাজা অব্যাহত বিমান হামলা, অপুষ্টি, বাস্তুচ্যুতি এবং জনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে বিপর্যস্ত পরিস্থিতিকে বিপর্যয়কর এবং ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে বর্ণনা করেছেন জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রদানকারীরা। শনিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে চীনের বার্তা সংস্থা সিনহুয়া। প্রতিবেদনে বলা হয়, শুক্রবার জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) এক বিবৃতিতে জানায়, বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ ও এর মানবিক অংশীদারদের কাছ থেকে ত্রাণবাহী পাঁচটি ট্রাক গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে, যা গত চার দিনের মধ্যে প্রথম প্রবেশ। একই চেকপয়েন্ট, কেরেম শালোম/কারেম আবু সালেম ক্রসিং থেকে আরও ৬০টি ট্রাককে ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এলাকায় তীব্র সংঘর্ষের কারণে ত্রাণের ট্রাকগুলোকে লোডিং জোনে ফিরে যেতে হয়েছিল। জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয় অফিস (ওচা) এর মুখপাত্র জেন্স লারকে শুক্রবার বলেছেন, গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার ১০০ শতাংশই এখন ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধার’ দ্বারপ্রান্তে। লার্ক বলেন, ‘গাজায় সীমিতসংখ্যক ট্রাক বোঝাই আসছেÑ এটি চাহিদার তুলনায় ফোঁটা-ফোঁটা খাবার। আমরা যে সাহায্য অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্তুত, তা একটি কার্যকরী স্ট্রেইটজ্যাকেটের মধ্যে আটকে দেওয়া হচ্ছে যা এটিকে কেবল আজকের বিশ্বেই নয়, সাম্প্রতিক ইতিহাসেও সবচেয়ে বাধাগ্রস্ত সাহায্য অভিযানগুলোর মধ্যে একটি। জাতিসংঘের এই মানবিক সংস্থা আরও জানায়, গাজার জনগণ এখন অনাহারের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে এবং অবিলম্বে সহায়তা প্রবেশের অনুমতি না দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে রূপ নিতে পারে। ওচা এর মুখপাত্র জেন্স লারকে বলেন, ইসরায়েল এখনো গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি অনুমোদিত ৯০০টি সাহায্যবাহী ট্রাকের মধ্যে মাত্র ৬০০টি গাজায় প্রবেশ করতে পেরেছে। তিনি বলেন, আমরা যা নিয়ে যেতে পেরেছি, তা কেবল ময়দা। এটি রান্না না করলে খাওয়ার উপযোগী নয়, অথচ গাজার শতভাগ জনগণ এখন দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় গত এক দিনে ৬০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে। এতে করে মার্চে যুদ্ধবিরতির পর গাজায় নিহতের সংখ্যা দাড়াল প্রায় দুই হাজারে। খবর কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার। এর মধ্যেই গাজায় ক্ষুধায় কাতর ত্রাণ পেতে মরিয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গুলিতে গত তিন দিনে অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৬২ জন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের সহায়তা নিতে গিয়ে নতুন করে আরও ২০ জন ইসরায়েলি গুলিতে আহত হয়েছেন। তারা সংস্থাটির নির্ধারিত বিতরণ কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ওই সময় তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। ইসরায়েলের নেটজারিম করিডরের কাছে নতুন বিতরণ কেন্দ্র খোলা হয়। ফিলিস্তিনিদের সেখান থেকে খাবার সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে বলা হয়। সংস্থাটির তৃতীয় সহায়তা বিতরণ কেন্দ্র এটি। এর আগের দুটি খোলা হয়েছে উপত্যকার দক্ষিণের শহর রাফায়। গাজায় ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত রয়েছে। গতকাল শুক্রবারও ইসরায়েলি হামলায় উপত্যকাজুড়ে অন্তত ১৮ ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। ইসরায়েলি বাহিনী গাজার আল-আওদা হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ রকম নির্দেশ দেওয়া অপরাধ; বিশেষ করে এমন মুহূর্তে, যখন ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি আক্রমণের মুখে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না।
ফিলিস্তিনের গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর সেখানে ৫০ হাজারের বেশি শিশু নিহত বা আহত হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে। সংস্থাটি হুঁশিয়ার করে বলেছে, এ উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার মাত্রা দিন দিন খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে। ইউনিসেফ গত মঙ্গলবার এ বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে আরও বলা হয়, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার সবচেয়ে বেশি মূল্য দিচ্ছে শিশুরা। সেখানে প্রতি ২০ মিনিটে গড়ে একটি শিশু হয় নিহত, না হয় আহত হচ্ছে। ইউনিসেফের প্রধান ক্যাথরিন রাসেল বলেন, ‘মারাত্মক লঙ্ঘন (আইনের)। অবরুদ্ধে ত্রাণ। ক্ষুধা। বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতালÑ সব বিধ্বস্ত। এটা শৈশবকে ধ্বংস করা। জীবনেরই ধ্বংস। এরা শিশু এরা সংখ্যা নয়। এভাবে কোনো শিশুর বেঁচে থাকার কথা নয়। আর একটি শিশুও নয়।’
ফিলিস্তিনের বার্তা সংস্থা ওয়াফা স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, গাজা সিটি ও খান ইউনিসে চালানো বিমান হামলায় সাত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে একটি পুরো পরিবারও রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজা সিটির আল-শান্তি এলাকার ওমর মসজিদের পাশে একটি তাঁবুতে চালানো হামলায় আরাফাত দিব তার স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ নিহত হয়েছেন। সবশেষ এই হতাহতের ঘটনায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গাজায় মোট প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৩৮১ জনে। আর আহত হয়েছেন ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮১ জন।