ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ জুন, ২০২৫

জাল টাকার কারবারিরা সক্রিয় টার্গেট কোরবানির পশুর হাট

শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশিত: জুন ২, ২০২৫, ০৪:৩৭ এএম
ছবিঃ রূপালী বাংলাদেশ

ভাড়া বাসার একটি কক্ষে শুধু ল্যাপটপ, প্রিন্টার। নেই কোনো আসবাপত্র। কক্ষজুড়ে ১০০, ২০০ ও ৫০০ টাকার নোট বিছিয়ে রাখা। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এগুলো নকল। এভাবেই কম্পিউটার, প্রিন্টার আর ফটোসপের মাধ্যমে মুহূর্তেই বানিয়ে ফেলা হচ্ছে জাল নোট। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এনায়েতনগরের একটি বাসায় জাল নোট তৈরিকালে অভিযান চালিয়ে আল-আমিন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-২।

এ ঘটনার পরদিন রাজধানীর পল্লবীর একটি বাড়িতে জাল নোট তৈরির কারখানায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে চক্রের এক নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। শুধু আল-আমিন আর ওই নারীই নন, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে একাধিক চক্র সক্রিয় রয়েছে। এরা সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করছে জাল নোট। এ ছাড়া ওষুধের প্যাকেটে লুকিয়ে বা বিভিন্ন কৌশলে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, ঈদুল আজহা ঘিরে অন্যান্য বছরের মতো এরই মধ্যেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে জাল টাকার কারবারিরা। এসব চক্রের বিভিন্ন জেলায় এজেন্ট আছে, যাদের মাধ্যমে অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি নকল টাকা। গ্রামীণ অনেক হাটে টাকা পরীক্ষা করার যন্ত্র না থাকায় এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে জাল নোটের কারবারিরা।

গোয়েন্দারা বলছে, বিভিন্ন সময়ে আটক হওয়া জাল নোটের কারবারিরা জামিনে বের হয়ে ফের একই পেশায় জড়াচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন কারবারি। তারা বাসাবাড়িতে ছোট ছোট প্রিন্টার ও কম্পিউটার নিয়ে এসব কাজ করছে। দ্রুত ও নিখুঁত জাল নোট তৈরি করতে ব্যবহার করছে বিশেষ অ্যাপ। তবে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে বাজারে জাল নোট ছড়ানোর অপচেষ্টা রুখতে নিয়মিত অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। 

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এনায়েতনগরের ভাড়া বাসার একটি ফ্ল্যাটে জাল নোট তৈরির কারখানা খুলে বসেছিলেন আল-আমিন। ঈদ সামনে রেখে চলছিল জাল নোট ছাপার কাজ। কম্পিউটার, প্রিন্টার ও ফটোসপের মাধ্যমে মুহূর্তেই বানিয়ে ফেলেন হুবহু ৫০, ১০০, ২০০ ও ৫০০ টাকার নোট। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ওই কারখনায় গত ২৫ মে রাতে অভিযান চালায় র‌্যাব-২। গ্রেপ্তার করা হয় কারখানার মালিক আল-আমিনকে। উদ্ধার করা হয় জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম এবং জাল নোট বিক্রির নগদ টাকা।

র‌্যাব-২-এর অধিনায়ক মো. খালিদুল হক হাওলাদার জানান, ওই বাসায় ছাপানো নকল টাকা শুকানোর হিটিং সিস্টেম ও লাইটিং সিস্টেম ছিল। এ ছাড়া ছাপানো নোটগুলো আসল টাকা বোঝাতে ছাপা নোটের মধ্যে ফয়েল পেপার দিয়ে দেওয়া হতো। আল-আমিন একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। দীর্ঘদিন ধরে এই চক্র রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় জাল নোট সরবরাহ করে আসছিল। ঈদ উপলক্ষে আবারও সক্রিয় হয়েছিলেন তারা।

তিনি জানান, আল-আমিন ও তার সহযোগী চক্ররা কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে গরু-ছাগলের হাটে জাল নোট ছড়িয়ে দেওয়ার একটা পরিকল্পনা নিয়ে নোট ছাপাচ্ছিলেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল নারায়ণগঞ্জ থেকে টাকাগুলো ছাপিয়ে ঢাকা মহানগরের গরুর হাটে ছড়িয়ে দেওয়া। তাদের কয়েক কোটি টাকা ছাপানোর টার্গেট ছিল। প্রতি ১ লাখ টাকার জাল নোট ৯ হাজার টাকায় বিক্রি করা হতো।

তিনি বলেন, চক্রটি এতটাই দক্ষ যে তাদের জাল করা নোট হুবহু আসল টাকার মতো দেখতে। যে কেউ হঠাৎ করে হাতে নিয়ে চিনতে পারবে না কোনটা আসল আর কোনটা নকল। শুধু তাই নয়, চক্রটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই জাল নোট পৌঁছে দিচ্ছে। ঈদ সামনে রেখে বাজারে জাল নোট ছড়ানোর অপচেষ্টা রুখতে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে র‌্যাব।

এ ঘটনার পরদিন অর্থাৎ, ২৭ মে মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর পল্লবীর একটি বাড়িতে জাল নোট তৈরির কারখানায় বিশেষ অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। অভিযানে ৯৭ হাজার টাকার জাল নোট ও জাল নোট তৈরির সরঞ্জামসহ এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২৯ মে বরিশালের হিজলা উপজেলার কাউরিয়া বন্দরে জাল নোটসহ সাদ্দাম হোসেন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
 
২৬ মে গভীর রাতে পটুয়াখালী সদর থানার মৌকরণ গ্রামে অভিযান চালিয়ে জাল নোট ও নোট তৈরির সরঞ্জামসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৮। র‌্যাব-৮-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক অমিত হাসান বলেন, ঈদ সামনে রেখে কিছু অসাধু ব্যক্তি জাল নোট তৈরি করে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাই জাল নোট রোধে অয়ন মীরের ভাড়াবাড়িতে অভিযান চালানো হয়। এ সময় তার বাড়িতে জাল নোট কিনতে বেশ কিছু ব্যক্তি অবস্থান করছিল। অভিযানকালে অয়নসহ জাল নোট কিনতে আসা তামিমকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় পটুয়াখালী সদর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
 
২২ মে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের রুস্তমপুরে একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৩ লাখ টাকার জাল নোটসহ যুগেন্দ্র মল্লিক নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই দিন বিকালে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে জাল নোট ক্রয়-বিক্রয়কালে সুজাত মিয়া নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
  
২১ মে বুধবার খুলনার সাচিবুনিয়া বিশ্বরোড মোড়ে খুলনাগামী টুঙ্গীপাড়া এক্সপ্রেস নামে একটি যাত্রীবাহি বাসে অভিযান চালিয়ে ৫ লাখ টাকার জাল নোটসহ খোরশেদ আলম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

১৭ মে কিশোরগঞ্জের মানিকখালী রেলওয়ে স্টেশনে অভিযান চালিয়ে জাল নোট চক্রের সক্রিয় সদস্য আতিকুর রহমান নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে রেলওয়ে পুলিশ। পুলিশ জানায়, আতিকুর কুমিল্লা থেকে জাল নোট সংগ্রহ করে বিভিন্ন ব্যস্ততম দোকানে সন্ধ্যার পরে অল্প আলোয় আসল টাকার সঙ্গে জাল নোট মিশিয়ে কেনাকাটা করে আসছে। এ ছাড়া চক্রটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে জাল নোট বিক্রির বিজ্ঞাপন প্রচার করত। এরপর জাল নোটের কারবারিরা অর্থের বিনিময়ে নির্ধারিত স্থান থেকে জাল নোট সংগ্রহ করত। আতিকুর রহমান জাল টাকা ও জাল টাকার ডিলার পয়েন্ট নামক ফেসবুক পেজের সক্রিয় সদস্য।

গত ১৪ ও ১৫ মে ঢাকা ও পঞ্চগড়ে অভিযান চালিয়ে জাল নোট তৈরি ও বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৮২ হাজার ৩০০ টাকা মূল্যমানের জাল নোট, জাল নোট বিক্রির ২ লাখ ১৪ হাজার টাকা এবং জাল নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

গোয়েন্দারা জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে জাল নোট তৈরি করে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করছিল। তারা কোরবানি ঈদ সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ জাল নোট তৈরি ও সরবরাহের পরিকল্পনা করছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে।
 
১০ মে রাজধানীর ডেমরা থেকে আট লাখ সমমূল্যের জাল নোটসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, এই চক্রে নারী সদস্যও রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে জাল নোটের কারবার করে আসছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সামাজিক মাধ্যমেও বিভিন্ন পেজ খুলে জাল নোটের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে কারবারিরা। ওই সব পেজে অর্ডার দিলে রয়েছে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও। ‘এ গ্রেট জাল নোট পাইকারি’, ‘জাল টাকা বিক্রি ডিলার’, ‘টাকার শহর’, ‘জাল টাকার গ্রুপ’, ‘জাল নোট বিক্রি করি’, ‘জাল টাকা বিক্রয় প্রতিনিধি’, ‘জাল টাকা বিক্রি’সহ বেশ কিছু পেজ শনাক্ত করে নজরদারিতে রেখেছে গোয়েন্দারা। ‘জাল টাকা বিক্রি ডিলার’ নামে একটি পেজে বিজ্ঞাপনে লেখা রয়েছে, ‘জাল টাকা বিক্রি করি। ১ লাখ টাকা পাচ্ছেন মাত্র ১৫ হাজার টাকায়। এ গ্রেডের ভালো মানের নোট আছে, যারা নিতে ইচ্ছুক তারা ইনবক্সে আসেন। আমাদের কাছে প্রচুর পরিমাণ নোট আছে ৫০/১০০/২০০/৫০০/১০০০ এ গ্রেডের ডুয়েল প্রিন্ট দ্বারা তৈরি করা। নোট দিচ্ছি সারা দেশ ক্যাশ অন ডেলিভারি।’

অপর একটি পেজে লেখা রয়েছে, ‘জাল টাকা বিক্রি করি, ১ লাখ টাকা পাচ্ছেন মাত্র ২৫ হাজার টাকায়। এ গ্রেডের ভালো মানের নোট আছে। যারা মাল নিতে ইচ্ছুক, তারা ইনবক্সে আসেন। আমাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে নোট আছে, সব জায়গায় চালাতে পারবেন, ০.৫ কটন পেপার দিয়ে তৈরি, কেউ হাতে নিয়ে বুঝতে পারবে না।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে সব ধরনের অপতৎপরতা রোধে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। জাল নোট, অজ্ঞান পার্টি-মলম পার্টি রোধে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। এরই মধ্যে জাল নোট চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমেও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ সময় তিনি জাল নোট সরবরাহ রোধে পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের সচেতন ও সতর্ক হওয়ার অনুরোধ করেছেন।