৮ বছরের শিশু আর্ছিয়া। বড় বোনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়াই কাল হয়েছিল তার। চলতি বছরের মার্চ মাসে মাগুরায় নিজের বড় বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে তার বোনের শ্বশুর এবং স্বামীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় আছিয়া। ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে একসময় হার মানে আছিয়া।
এ ঘটনার পরই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রকাশ্যে আসতে থাকে ধর্ষণের খবর। বিশেষ করে পরিবারের বায়োজ্যেষ্ঠদের দ্বারা কয়েকদিনের ব্যবধানে বেশ কয়েকজন শিশুর ধর্ষণের খবর সামনে আসে তখন।
সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে এক গৃহবধূকে তার ঘরে ঢুকে ধর্ষণ এবং বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণকাণ্ডে আবারও আলোচনায় এসেছে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি। কেউ কেউ ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন খোদ নিজের স্বজনদের কাছেই। প্রশ্ন উঠেছে, ঘরে-বাইরে কোথায় নিরাপদ নারীদের জীবন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক পরিসংখ্যান বলছে, দেশজুড়ে শুধু মে মাসেই ধর্ষণ এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮৪ নারী ও শিশু। কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে দোষীরা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। এমন চলতে থাকলে নারীদের এগিয়ে যাওয়া চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ধর্ষণের পরিসংখ্যান
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছরের মে মাসে মোট ১৮৪ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র- আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারী। এদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণের পর হত্যার দুটি ঘটনা ঘটেছে।
এদের মধ্যে পাঁচজন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীও রয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী রয়েছেন। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনজন কিশোরী ও ১৪ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুজন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ছিল দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বেশি। এ ছাড়া পারিবারিক সহিংসতা ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বিগত মাসগুলোর মতো একই ধারাবাহিকতায় ঘটেছে, যা ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, তা দৃশ্যমান হয়নি। ফলে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ঘটেছে, যা জাতীয় জীবনে অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯ জন। এর মধ্যে একজনকে ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ২১ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ের যত ধর্ষণকাণ্ড
সম্প্রতি আলোচিত ধর্ষণকাণ্ডগুলোর মধ্যে ৬ মার্চ মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যু হয় শিশু আছিয়ার। ঠিক এর পর দিন ৭ মার্চ কুমিল্লার লালমাইয়ে চিপস কিনে দিয়ে প্রতিবন্ধী তরুণীকে সংঘবন্ধ ধর্ষণ করা হয়। ৮ মার্চ দিনে খাবার ও বেলুনের লোভ দেখিয়ে মুন্সীগঞ্জে দুই শিশুকে ধর্ষণ করে এক বৃদ্ধ। যদিও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এখনো সুষ্ঠু বিচার পায়নি পরিবার।
একই দিনে ফরিদপুরে সাইকেলে ঘোরানোর কথা বলে শিশুকে ধর্ষণ করে এক কিশোর এবং টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ঘটে আরেকটি ধর্ষণের ঘটনা। যেখানে সালিশের মাধ্যমে করা দেড় লাখ টাকা জরিমানার নামে ধামাচাপা দেওয়া হয় বিষয়টি। এর পরের দিন ৯ মার্চ সীতাকুণ্ডে সৈকতে বন্ধুকে বেঁধে রেখে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। একই দিন নরসিংদীতে ৩ দিন আটকে রেখে গর্ভবতী নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়।
প্রতিবাদে ফুঁসছে দেশ
সব ঘটনা আলোচনায় না আসলেও সম্প্রতি মাগুরার আছিয়ার পর কুমিল্লার মুরাদনগর কাণ্ডে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। ৬৭টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফরম পক্ষ থেকে দেওয়া হয় প্রতিবাদ বিবৃতি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় এক নারীকে দরজা ভেঙে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ধর্ষণের ঘটনার ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ভাইরাল করা হয়। এ ঘটনায় সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি (৬৭টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফরম) গভীর উদ্বেগ, তীব্র নিন্দা ও শঙ্কা প্রকাশ করছে।
তিনি বলেন, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি মনে করে এই ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নয়, সামগ্রিকভাবে নারীর জীবনের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও মানবাধিকারের ওপর চরম আঘাত। ঘরে অবস্থান করেও নারীরা যদি সুরক্ষিত না থাকেন, তবে তা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নাগরিক নিরাপত্তার গুরুতর সংকটের ইঙ্গিত বহন করে। এ ছাড়াও একে অপরের প্রতি দোষারোপ করে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টিকে হালকা করে দেখার মানসিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নারী নির্যাতনের মাত্রা কমলে আমরা খুব খুশি হতাম। কিন্তু এটা কমার কোনো লক্ষণ দেখছি না। বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সমাজে নারী বিদ্বেষী মনোভাব বাড়ছে। নারীবিরোধী গোষ্ঠী আবার তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা ধর্মকে নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, নারীর চলাচলে বাধা দিচ্ছে, নারীর পোশাকের প্রতি আঙুল তুলছে, ধর্মকে হিংসা‑বিদ্বেষের কারণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার যিনি নারীর দিকে আঙুল তুলছেন তাকে ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। এগুলো তো ভালো লক্ষণ না।
নিরাপত্তা রক্ষায় হিমশিম সরকার
ধর্ষণ ও নারী নিপীড়ন ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষিত হওয়ার পর কুমিল্লার মুরাদনগরের ঘটনায় উদ্বেগ জানানো হয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে। আছিয়া কাণ্ডে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করার কথা জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। মামলার তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা কথাও বলা হয়। ধর্ষণের মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার করার বাধ্যবাধ্যকতা রাখার কথা বলা হয়। অংশীজনদের সঙ্গে কিছু পরামর্শ করে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে বলেও জানানো হয়। এ ছাড়াও যৌন নিপীড়ন মোকাবিলায় হটলাইনও চালু করার কথা ভাবে অন্তর্বর্তী সরকার।
এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এক বক্তব্যে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পক্ষ থেকে আমি জানাচ্ছি যে, রাস্তাঘাটে যে যৌন নিপীড়ন হয়, হয়রানি হয়- এই ব্যাপারে প্রতিকার নিশ্চিত করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দ্রুত একটা আলাদা হটলাইন প্রদান করা হবে। সম্ভবত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে (নম্বর) জানিয়ে দেওয়া হবে; রাস্তাঘাটে যেকোনো ঘটনা ঘটলে হটলাইনে ২৪ ঘণ্টা টাইম থাকবে অভিযোগ দেওয়ার জন্য। যা এখনো পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়েছে। কবে নাগাদ এটি বাস্তবায়ন হবে তাও বলতে পারছেন কেউ।
তবে এ বিষয়ে সুষ্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, আমি আগের সরকারের সময়ের সঙ্গে বর্তমান সময়ের তুলনা করতে চাই না। শুধু বলতে চাই, ১৫ বছরের জঞ্জাল ৫ মাসে সমাধান চাইলে হবে না। আমরা চেষ্টা করছি। পুরুষরূপী এই হায়েনাদের বিরুদ্ধে কীভাবে বিচার নিশ্চিত করা যায় সেই চেষ্টা চলছে।
বিশিষ্টজনদের ক্ষোভ
নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেছেন, যেগুলো সামনে আসছে সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। কিন্তু ভয় ও সামাজিক চাপের কারণে অনেক বেশি ভুক্তভোগী নীরবে ভুগছে, অভিযোগ দায়ের করতে পারছে না। আমাদের বিচার ও সুরক্ষা ব্যবস্থা নারী ও শিশুদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এসব বাঁধা দূর করতে না পারলে নারীদের চলার পথ সুগম হবে না কখনো।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, একটা নতুন বাংলাদেশ গড়তে আমরা সবাই মিলে কাজ করছি। এখানে যদি আমাদের নারীরা প্রতি পদে পদে আতংকিত থাকে তাহলে তো উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবেই। বিশেষ করে নারীরা যেখানে নিজের ঘরেও নিরাপদ নয়। বাইরের কথা আর নাই বললাম। ঘরে-বাইরে নারীর চলার পথ সুগম করতে যা করণীয় সরকারকে তাই করতে হবে।

 
                             
                                    

 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন