ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই, ২০২৫

গুলশান, বনানী ও বাড্ডা এখন ক্রাইম জোন 

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: জুলাই ৩, ২০২৫, ০২:১৩ পিএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী ও পার্শ্ববর্তী বাড্ডা ক্রমেই অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা অপরাধীরা গা ঢাকা দেয়। সেই শূন্যস্থান দখলে এখন তৎপর নতুন পরিচয়ের অপরাধীরা।

আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধা করতে না পারা সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়েও তৎপরতা বাড়াচ্ছে অপরাধীরা। এসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি নেতাসহ অন্তত ১০টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।

এর বাইরে নিয়মিত ঘটছে ছিনতাই ও মাদক কারবারের ঘটনা। বড় ধরনের ক্রাইম জোনে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় এসব এলাকার বাসিন্দারা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন।

গত ২৫ মে রাতে গুলশান থানা বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর বেশ কয়েক দিন আগে গুলশানে পুলিশ প্লাজার সামনে বিএনপিপন্থি ইন্টারনেট ব্যবসায়ী সুমন মিয়াকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ছিনতাই, মাদক কারবারসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্থানীয় অপরাধীদের পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষসন্ত্রাসীদের ইন্ধনে এসব এলাকায় চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সেই সঙ্গে আধিপত্য ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে শীর্ষসন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে একটি রাজনৈতিক দুষ্টচক্র। সব মিলিয়ে এসব এলাকার বাসিন্দারা রয়েছেন আতঙ্কে।

গত ২৫ মে বিএনপি নেতা সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার এক মাসের বেশি পার হলেও এখনো কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বিএনপির এই নেতার স্বজনদের দাবি, রাজনৈতিক কারণে হত্যা করা হয়েছে সাধনকে।

এর আগে গত ১৯ এপ্রিল রাতে হাতিরঝিল থানাধীন নয়াটোলা মোড়ল গলিতে গুলিবিদ্ধ হন মতিঝিল থানার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য মো. আরিফ সিকদার। ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে দুই দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা যান তিনি।

একই দিনে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বনানীতে খুন হন ছাত্রদলের কর্মী পারভেজ। গত ১৫ জুন বাড্ডায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন এক দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নিহত আনোয়ার পরিবার নিয়ে বাড্ডার আনন্দনগর এলাকায় থাকতেন। শুধু এগুলোই নয়, গত ৫ আগস্টের পর থেকে এসব এলাকায় মোট ১০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

জানা গেছে, গত পাঁচ মাসে রাজধানীতে ১৯৯টির বেশি হত্যা মামলা রেকর্ড হয়েছে, যার ৪০ শতাংশই রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে বলে মনে করছে পুলিশ। আর এই রাজনৈতিক প্রভাবকে কেন্দ্র করে পূর্ববিরোধ, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি এবং বৈধ-অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ঘটছে এসব হত্যাকাণ্ড। অনেক হত্যাকাণ্ডে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কিলার ভাড়া করা হচ্ছে। আন্ডার ওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও জড়িয়ে পড়েছে এসব ‘কিলিং বাণিজ্যে।’ 

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ক্রাইম বিভাগের এক সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) বলেন, গুলশান, বনানী ও বাড্ডা এলাকার আধিপত্য ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে কোনো কোনো রাজনৈতিক পক্ষ শীর্ষসন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। টার্গেট করে বিরোধী পক্ষের লোকদের ওপর হামলা ও খুন করা হচ্ছে। এ ছাড়া গুরুতর জখমের ঘটনাও প্রায়ই ঘটছে। অনেক সময় একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তাদের ওপর ও হামলার ঘটনাও ঘটছে।

জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল বলেছন, ‘ঢাকা বড় শহর, অনেক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। একটানা ১৭ বছর এক সিস্টেমের শাসনব্যবস্থা ছিল। এখন নতুন করে আরেকটা শাসনব্যবস্থা চলছে। তবে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমাদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই আছে।

গত বছরের জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মামলা এখনো রেকর্ড হচ্ছে। এ কারণে মামলার সংখ্যা বেড়েছে হয়তো। গুলশান-বনানী ও বাড্ডা এলাকা আমাদের আলাদা নজরদারিতে রয়েছে। বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের এখানে সাম্প্রতিক সময়ে চাঞ্চল্যকর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম মামলা হলো বিএনপি নেতা সাধনকে হত্যা। তবে অন্যান্য অপরাধও কম নয়। 

সূত্র বলছে, কামরুল হত্যার নেপথ্যে ছিল পূর্ববিরোধ ও এলাকার আধিপত্য। এ হত্যায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক গডফাদারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বিশেষ করে গুলশান ও বাড্ডা এলাকায় শীর্ষসন্ত্রাসীদের নামে তোলা চাঁদার টাকা নিয়েই ঘটে বিপত্তি। ঘটনার পরেই ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে দুই সন্ত্রাসীকে শনাক্ত করার কথা পুলিশ জানালেও তেমন কোনো ফল আসেনি। হত্যায় জড়িত কাউকে ধরা যায়নি এখনো। ধারণা করা হচ্ছে, তারা (খুনিরা) ভাড়াটে কিলার।

মতিঝিল থানার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ সিকদার হত্যার ঘটনায় মামলায় প্রধান অভিযুক্ত ও শীর্ষসন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ‘শুটার’ মাহফুজুর রহমান বিপুকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। বিপু পর্দার আড়াল থেকে হত্যায় কলকাঠি নেড়েছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দারা।

র‌্যাব জানায়, বিপু শীর্ষসন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন এবং তার একটি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। গুলশান, বনানী, মগবাজার ও হাতিরঝিল এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন বিপু। জানতে চাইলে ডিবি তেজগাঁও বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-কমিশনার (ডিসি) রাকিব খান জানান, ‘আরিফ সিকদার হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত আমরা পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছি। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে।’

এসব বিষয়ে অপরাধ বিশ্লেষক মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক মুহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন, সারা দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড থামাতে প্রয়োজন সুশাসনভিত্তিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা।

রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সঠিক সময়ে নির্বাচনেরও দরকার। আলোচনার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার গঠন করতে পারলেও এগুলো অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের দেশে অপরাধের গতির চেয়ে নিয়ন্ত্রণের সিস্টেমের শক্তি অনেক দুর্বল।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে হত্যাকাণ্ডসহ অপরাধ পরিস্থিতি বর্তমানে এক উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে তুচ্ছ কারণে বড় ধরনের অপরাধ, মব সহিংসতা বাংলাদেশে অপরাধের একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। সমাজে ভয় ও উদ্বেগ বাড়ছে।’